খালেদা-তারেকের 'সম্মান রক্ষায়' ভোট চাইলেন ফখরুল

বিএনপির ইশতেহার ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর ডানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। মির্জা ফখরুলের বাঁয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। ছবি: সাইফুল ইসলাম
বিএনপির ইশতেহার ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর ডানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। মির্জা ফখরুলের বাঁয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। ছবি: সাইফুল ইসলাম

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘সম্মান’ ও ‘মর্যাদা’ প্রতিষ্ঠা এবং বিএনপির ঘরছাড়া নেতা-কর্মীদের ঘরে ফেরার সুযোগ দিতে ভোট চাইলেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আপনাদের একটি ভোট আমাদের নেত্রীর জীবনকে পুনরায় আলোয় উদ্ভাসিত করবে।’

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ইশতেহার প্রকাশকালে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি কী কী করবে, তা তুলে ধরেন তিনি। ইশতেহারের বেশির ভাগই ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারের সঙ্গে মিল রয়েছে।

বিএনপির ইশতেহারে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সম্পর্কে বলা হয়, নির্বাচনের দিনটিকে বিএনপি গণতন্ত্রের নিত্যদিনের অনুশীলনে পরিণত করবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনবে। বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার দেবে। সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন ও গণভোট পুনঃপ্রবর্তন করবে। নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো প্রবর্তন করবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনের জন্য জাতীয় কমিশন গঠন করবে। এ ছাড়া ন্যায়পাল নিয়োগ, র‌্যাবের পুনর্গঠন, পুলিশ ও আনসার ছাড়া শর্ত সাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা উঠিয়ে দেওয়া, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর যাতায়াতের সময় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রসঙ্গ রয়েছে।

নিম্ন আদালতকে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করারে কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিচারব্যবস্থার সংস্কারে জুডিশিয়াল কমিশনের কথা ইশতেহারে বলা হয়েছে। ইশতেহারে মতপ্রকাশের অবারিত স্বাধীনতা, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল, বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করা, গুম-খুন ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতন বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ বাজেটের ৩০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে।

বর্তমান সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ না করার প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি এসব কাজের দুর্নীতি নিরীক্ষা করে দেখবে বিএনপি। বর্তমান সরকারের শেষ দুই বছরে তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করা হবে।

গতকাল সোমবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার প্রকাশ হয়। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে এই ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক দল বিএনপি। আজ বিএনপি আলাদা করে ইশতেহার দিল।

দুটি দুর্নীতির মামলায় দণ্ড পেয়ে এখন কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। আর তিনটি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমান আছেন লন্ডনে। এর মধ্যে ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমান যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন।

আজ নয় পৃষ্ঠার ইশতেহার তুলে ধরে বিএনপির মহাসচিব দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড নিয়ে বলেন, ‘আজকের এই মুহূর্তে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আমাদের সঙ্গে নেই। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে একটি পরিত্যক্ত ভবনে নির্জন কারাবাস করছেন।’ আর তারেক রহমান সম্পর্কে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই দেশে ফিরতে পারছেন না।’ তিনি তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় জনগণের কাছে বিএনপির পক্ষে ভোট চান।

মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা একটি জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকার গঠন করে। গত প্রায় ১০ বছরে দেশে কোনো রকম সুশাসন ও আইনের শাসন ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মামলা-হামলা, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে এক ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব। জনগণের বাক্‌স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দেশে আঞ্চলিক ও শ্রেণিবৈষম্য ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমে গেছে। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, ব্যাংকগুলো লুট হয়ে যাচ্ছে। দেশে সৃষ্টি হয়েছে দুর্বৃত্তায়ন ও লুণ্ঠনের অর্থনীতি।

বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, এ রকম একটি নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিতে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ লড়াই শুধু নির্বাচনে জয় পরাজয়ের লড়াই নয়, এ লড়াই অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। এ লড়াই ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুক্ত জীবনে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। বিএনপি একটি উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। দেশের উন্নয়নের জন্য বিএনপির কর্মসূচিগুলো বহুমুখী ও উন্নততর। বিএনপি জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে অঙ্গীকার করতে চায়, ক্ষমতায় গেলে কারও ওপরই কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। একটি প্রতিহিংসামুক্ত ও সহমর্মী বাংলাদেশ গড়ে তোলাই বিএনপির লক্ষ্য।

ভোটারদের উদ্দেশে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা নিজ ঘরে থাকতে পারছেন না। তাঁরা নিজ ঘরে ফিরতে চান। পেতে চান পরিবারের সান্নিধ্য, একটি স্বস্তিময় রাত। আপনাদের সমর্থন ঘরছাড়া এই মানুষগুলোকে ঘরে ফেরার সুযোগ করে দেবে। অবসান ঘটাবে জুলুম ও নির্যাতনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির। নির্বাচনে জয়লাভ করে ঐক্যের সরকার গঠন করলে ঐকমত্য, সবার অন্তর্ভুক্তি ও প্রতিহিংসাহীনতা—এই মূলনীতির ভিত্তিতে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।’

বিএনপির ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর ডানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান। ছবি: সাইফুল ইসলাম
বিএনপির ইশতেহার ঘোষণা অনুষ্ঠানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর ডানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান। ছবি: সাইফুল ইসলাম

বিএনপির ইশতেহারের যা আছে

প্রতিরক্ষা ও পুলিশ
প্রতিরক্ষা ও পুলিশের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা বলা হয়েছে ইশতেহারে। এতে বলা হয়, সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন করা হবে, যুদ্ধাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কেনা হবে। বর্তমান ও সাবেক সশস্ত্র বাহিনীর কর্মরত সবাইকে যৌক্তিক রেশনিং দেওয়া হবে এবং কল্যাণমূলক প্রকল্প নেওয়া হবে। পুলিশের ঝুঁকি ভাতা বাড়ানো হবে। ইন্সপেক্টর ও সাব–ইন্সপেক্টদের বেতন ছয় মাসের মধ্যে আপগ্রেড করা হবে।

মুক্তিযোদ্ধা
মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি আছে বিএনপির ইশতেহারে। এতে বলা হয়, ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের নামে দুর্নীতির অবসান ঘটানো হবে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের ভাতা বাড়ানো হবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা ও বধ্যভূমি-গণকবর চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে।

যুব, নারী ও শিশু
ইশতেহারে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত তরুণদের স্বার্থ রক্ষায় ইয়ুথ পার্লামেন্ট গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অধিকসংখ্যক শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া হবে। শিক্ষিত বেকারদের চাকরি না হওয়া পর্যন্ত বা এক বছরব্যাপী ভাতা দেওয়া হবে। নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার করা হবে।

শিক্ষা
বিদেশি ভাষা শিক্ষায় জোর দেওয়া হবে। স্বল্প সুদে শিক্ষাঋণ দেওয়া হবে। বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্যও ঋণ দেবে বিএনপি। ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেবে। খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের সম্মানী ভাতা দেবে। প্রশ্নফাঁস প্রতিরোধে ভূমিকা নেওয়া হবে। ভ্যাটবিরোধী, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সব মামলা তুলে নেওয়া হবে। প্রথম তিন বছরে দুই লাখ সরকারি চাকরি দেওয়া হবে, তরুণ দম্পতি ও উদ্যোক্তাদের ২০ বছর মেয়াদি ঋণ দেওয়া হবে। পাঁচ বছরে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান করা হবে।

তথ্য ও প্রযুক্তি
তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে ভিওআইপি ব্যবস্থায় উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হবে। সৃজনশীল ব্যক্তিদের মেধাস্বত্ব অধিকার নিশ্চিত করা হবে। সাশ্রয়ী মূল্যে সর্বোচ্চ ইন্টারনেট গতি নিশ্চিত করা হবে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে ব্যবহৃত সব উপকরণে শূন্য শুল্ক সুবিধা বজায় রাখা হবে। পর্যায়ক্রমে স্মার্ট সিটি, স্মার্ট পৌরসভা, স্মার্ট গ্রাম ও স্মার্ট ক্যাম্পাস গঠন করা হবে।

বিএনপির ইশতেহারে বলা হয়, জাতীয় ভাবধারার পরিপন্থী অপসংস্কৃতির চর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হবে। বিদেশফেরত প্রবাসীদের বিমানবন্দরে হয়রানি বন্ধ করা হবে। প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ১২ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হবে। সব খাতে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। শ্রমিক, খেতমজুরসহ দরিদ্র ব্যক্তিদের সুলভ মূল্যে রেশনিং দেওয়া হবে।

এ ছাড়া জ্বালানি খাত, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা, আবাসন, পররাষ্ট্র, পরিবেশ, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও সংখ্যালঘুদের জন্য ইশতেহারে বিভিন্ন সুবিধার কথা বলা হয়েছে। ইশতেহারের ভূমিকায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করলে ঐকমত্য, সবার অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিহিংসাহীনতা—এই মূলনীতির ভিত্তিতে বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনা করবে।

এ সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, মঈন খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।