স্ত্রী শুধুই প্রার্থী, বাকি সব স্বামীর

আয়েশা ফেরদাউস
আয়েশা ফেরদাউস

হাতিয়া যেতে ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চে ১৪ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হয়। নামতে হয় তমরুদ্দিন ঘাটে। ভাঙা জেটি আর বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে নামতেই চোখে পড়বে বিশাল কয়েকটি নির্বাচনী ব্যানার। পথের দুই ধারেও নানা রঙের পোস্টার। তাতে বড় করে হাতিয়া আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিচয় দেওয়া মোহাম্মদ আলীর ছবি। আর পাশে ছোট করে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আয়েশা ফেরদাউসের ছবি। স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা পোস্টার ও ব্যানারে তাঁদের নিজেদের ছবি যুক্ত করেও নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন।

হাতিয়া পৌরসভা এলাকায় প্রবেশ করতেই দেখি নৌকা মার্কার পক্ষে মিছিল। মিছিলের স্লোগান হচ্ছে ‘আলী ভাইয়ের সালাম নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন। আলী ভাইয়ের মার্কা নৌকা নৌকা’।

১৫ থেকে ১৮ ডিসেম্বরে হাতিয়ার তমরুদ্দিন ঘাট থেকে জাহাজমারা চর, নিঝুম দ্বীপ থেকে মৌলভীরচর, কমলাদীঘি থেকে সূর্যমুখী—যেখানেই গেছি, পথে পথে একই চিত্র। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে দলীয় প্রধান কিংবা সংসদ সদস্য প্রার্থীর চেয়ে হাতিয়া আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার ছবি এত বড় করে প্রচারের কারণ জানতে খোঁজ নিতে শুরু করি।

হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে নোয়াখালী-৬ আসনের আটজন প্রার্থীর তালিকা দেওয়া হলো। তাতে দেখা গেল, মোহাম্মদ আলী নামের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর মার্কা নোঙর। তাহলে তাঁর পক্ষে নৌকা মার্কায় ভোট কেন চাওয়া হচ্ছে?

উত্তর খুঁজতে ১৫ ডিসেম্বর রাতে হাজির হই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত বর্তমান সাংসদ এবং আসন্ন নির্বাচনের প্রার্থী আয়েশা ফেরদাউসের বাসায়। কয়েক একর জমির ওপর নির্মিত বিশাল বাড়িভর্তি তখন আওয়ামী লীগের হাজারখানেক নেতা-কর্মী। বাড়ির উঠানে একটি উন্মুক্ত মঞ্চে বসে আছেন সাংসদ এবং পাশে সেই মোহাম্মদ আলী। জানা গেল তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। নির্বাচনের প্রস্তুতি কেমন, জেতার আশা করছেন কি না, এলাকায় কী কী সমস্যা, সমাধানের কী পরিকল্পনা—একের পর এক এসব প্রশ্ন করতে থাকি। কিন্তু কোনো প্রশ্নের উত্তরই সাংসদ দিলেন না। মোহাম্মদ আলী সব প্রশ্নের জবাব দিলেন। পাশে বসে সাংসদ শুধু সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন।

তবে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মোহাম্মদ আলী হাতিয়ার নানা সমস্যা আর সমাধানের চেয়ে নিজের কথাই বেশি বললেন। প্রতিপক্ষ প্রার্থী বিএনপির ফজলুল আজিমের চেয়ে নোয়াখালী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরাম চৌধুরীর সমালোচনাই বেশি করলেন। তিনি নিজে সারা জীবন আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি করেছেন উল্লেখ করে মোহাম্মদ আলী জানালেন, ছাত্রজীবনের শুরুতে তিনি বামপন্থীদের সঙ্গে মিশতেন। এরপর যোগ দেন বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদলে। পরে জাতীয় পার্টি থেকে হাতিয়ার সাংসদ হন। সেখান থেকে আবার আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু নৌকার মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নৌকাকে পরাজিত করে আবারও সাংসদ হন। আবারও আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।

নিজেকে হাতিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমি নিজে একটি পার্টি, আর এর সঙ্গে আমার স্ত্রী আয়শা ফেরদাউসের মার্কা নৌকা যোগ হয়েছে। ফলে আমাদের এখানকার কেউ পরাজিত করতে পারবে না। নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরাম চৌধুরী প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিনি এলাকায় দস্যু আর সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে আমাকে দুর্বল করতে চেয়েছিলেন। তিনি হাতিয়ায় কয়েকবার আসতে চেয়েছিলেন, আমরা লাঠি নিয়ে তাঁকে প্রতিরোধ করে এলাকায় আসা ঠেকিয়েছি।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মুঠোফোনে একরাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মোহাম্মদ আলী আওয়ামী লীগের কেউ না। তাঁর স্ত্রী আওয়ামী লীগের সদস্য। তিনি একজন ভালো মানুষ, তাই তাঁকে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আর আলী সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই না। তিনি কী, তিনি কেমন, তা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের জিজ্ঞেস করেন।’

হাতিয়া থেকে নির্বাচনে দাঁড়ানো বিএনপির প্রার্থী ফজলুল আজিম সম্পর্কে সাংসদ আয়েশার কাছে জানতে চাইলে তাঁর উত্তরও মোহাম্মদ আলী দিয়ে দেন। বললেন, ‘আমার স্ত্রীর বাবা চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া আওয়ামী লীগের নেতা। ফজলুল আজিমও তাঁর সম্পর্কে মামা। তাই মামা যাতে এলাকায় ঠিকমতো রাজনৈতিক প্রচারণা চালাতে পারেন, তার সব ব্যবস্থা তিনি করেছেন।’

ফজলুল আজিম এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলীর স্ত্রী আমার কোনো আত্মীয় না। আলী একজন জলদস্যু সম্রাট। এলাকার সন্ত্রাসীদের গডফাদার। আমাকে হত্যার জন্য উনি লোক ভাড়া করেছেন। আমি এলাকায় কোনো পোস্টার লাগাতে পারছি না। নির্বাচন কমিশনের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না।’

দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর পর ভোটের প্রচারে ফজলুল আজিম ১৪ ডিসেম্বর হাতিয়ায় পৌঁছান। ওই দিনই তাঁর গাড়িবহরে হামলা হয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করতে দেওয়া হয়নি বলে হাতিয়া বিএনপি থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গ তুললে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বিএনপির অন্তঃকোন্দলের কারণে এসব হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কেউ এসব কাজে জড়িত না। বরং ফজলুল আজিম যাতে ঠিকমতো প্রচারণা চালাতে পারেন এবং নির্বাচনের শেষ দিন পর্যন্ত যাতে এলাকায় থাকেন, ভোট ছেড়ে পালিয়ে না যান, সেই ব্যবস্থা আমি করেছি।’

হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপের সাংসদ হিসেবে আয়েশা ফেরদাউসের নাম কাগজে–কলমে থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি অনেকটা ওই বৈঠকের মতোই। তিন দিনে সরকারি প্রশাসনযন্ত্র, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যার কাছেই যাওয়া গেছে, তার কাছেই কার্যত সাংসদ হিসেবে মোহাম্মদ আলীর নাম উঠে এসেছে। এমনকি হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তর থেকে ওই আসনের সংসদ সদস্য প্রার্থীদের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, সেখানে আয়েশা ফেরদাউসের বাসার ঠিকানা হিসেবে দেওয়া হয়েছে ‘এমপি মোহাম্মদ আলী সাহেবের বাসা, গ্রাম-চর কৈলাশ, উপজেলা হাতিয়া, জেলা নোয়াখালী’।

হাতিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ ও সাধারণ সম্পাদক তাঁরই ভাতিজা মহিউদ্দিন আহমেদ। মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে তাঁদের বিরোধ সেই আশির দশক থেকে।

মোহাম্মদ আলী আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর বেশির ভাগ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওয়ালীর অনুসারীরা বিএনপির প্রার্থী ও সাবেক সাংসদ ফজলুল আজিমের পক্ষে কাজ করেছে বলেও অভিযোগ আছে। তবে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ওয়ালীর ও আলীর অনুসারীদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের দিন তা কতটা কাজ করবে, তা নিয়ে স্থানীয়দের মনে সংশয় রয়েছে।

এ ব্যাপারে অধ্যাপক ওয়ালী উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আলী একজন চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী। তাঁর স্ত্রীকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়ায় আমরা নৌকার পক্ষে আছি। কিন্তু আমি ও হাতিয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলীকে আমাদের দলের কেউ মনে করি না। তাঁর কারণে হাতিয়া আওয়ামী লীগের ক্ষতি হচ্ছে।’