সুষ্ঠু নির্বাচনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

জাতীয় সংসদ ভবন। ফাইল ছবি
জাতীয় সংসদ ভবন। ফাইল ছবি

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ এখন বিভক্তিরেখার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তবে সেটি নীতি-আদর্শের বিভক্তি নয়। ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার লড়াইয়ের বিভক্তি। এ কারণে একদা খাঁটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীরা এখন বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। আর বাঙালি জাতীয়তাবাদী তথা ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা ধর্মবাদীদের কোলে টেনে নিয়েছেন।

এক পক্ষ ‘গণতন্ত্র সুরক্ষার’ স্লোগান দিয়ে মাঠে নেমেছে। আরেক পক্ষ ক্ষীণকণ্ঠে হলেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আওয়াজ তুলেছে। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে ‘গণতন্ত্র হত্যার’ অভিযোগ এনেছে। যাঁরা বর্তমানে ও অতীতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছেন বা ছিলেন, তাঁরা যদি প্রতিপক্ষের ভাষায় গণতন্ত্র হত্যা করে থাকেন, তাহলে জনগণের বিচলিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে জনগণের প্রধান উদ্বেগ হলো তাঁরা ভোটটি দিতে পারবেন কি না।

নির্বাচন এলে প্রতিবারই বাংলাদেশের মানুষ একটি ক্রান্তিকালে এসে দাঁড়ায়। তারা আশায় বুক বাঁধে—এবার বুঝি সুদিন আসবে। কিন্তু জনগণের কাঙ্ক্ষিত সুদিন অধরাই থেকে যায়। রাজনীতিকেরা আমাদের হিমালয় পরিমাণ ওয়াদা করে থাকেন এবং টিলা পরিমাণও তা পূরণ করার প্রয়োজন বোধ করেন না।

আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিপক্ষ বলে কিছু থাকতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনেই সব দলকে, ব্যক্তিকে রাজনীতি করতে হয়, নাগরিকত্ব রক্ষা করতে হয়। যদি কারও হাতে অকাট্য তথ্যপ্রমাণ থাকে যে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বার্থের বা স্বাধীনতার বিপক্ষে কাজ করেছে, তাহলে তার নাগরিকত্বই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। এভাবেই স্বাধীনতার পর কতিপয় দালালের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার পাশাপাশি গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজে জড়িত থাকার দায়ে কতিপয় যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। আরও অনেকে বিচারের অপেক্ষায় আছেন।

তবে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো বায়বীয় বিষয় নয়। এটি ঠুনকো কোনো বিষয় নয় যে গুটিকয়েক স্বাধীনতাবিরোধী মানুষ ইচ্ছে করলেই ধ্বংস করে দিতে পারবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি প্রত্যয়, যা লেখা হয়েছিল রক্তের অক্ষরে, লাখ লাখ মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ও প্রধান প্রত্যয় হলো গণতন্ত্র। আর সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপায় হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে সরকার গঠনের অবাধ সুযোগ দেওয়া। প্রজাতন্ত্রের মালিক কোনো দল বা নেতা নন, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার আন্দোলন–সংগ্রামকালে এ কথাটি বলেছেন। তাই আমরা মনে করি, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই হলো মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা, যে নির্বাচনে দলমত-ধর্মবর্ণ-জাতিনির্বিশেষে নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তাঁর ভোটটি দিয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসতে পারবেন। কোনো পর্যায়েই তাঁকে হয়রানি বা নিগ্রহের শিকার হতে হবে না। ভোটের আগে, ভোটের সময় এবং ভোটের পরও তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

মুক্তিযুদ্ধের অনন্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হইল।’ আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি, তাহলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দিতে হবে। গায়ের জোরে কিংবা কোনো আইন দ্বারা সেই স্বাধীনতা খর্ব বা রহিত করা যায় না।

গতকাল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। দুটি ইশতেহারে ত্বরিত চোখ বুলিয়ে যেটি পাওয়া গেল, তা হলো, বিএনপির চেয়ে ধর্মের কথা আওয়ামী লীগই বেশি বলেছে। তারা শুধু কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী আইন না করার ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; সারা দেশে ৫৬০টি মসজিদ-কাম-ইসলামী কালচারাল সেন্টার নির্মাণের কথাও বলেছে। ধর্মবাদী পাকিস্তান রাষ্ট্রে শাসকদের অপপ্রচারের হাত থেকে রেহাই পেতে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও যুক্তফ্রন্টকে এই অঙ্গীকার করতে হয়েছিল। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাঋদ্ধ এবং চার মূলনীতির ধারক বলে পরিচিত আওয়ামী লীগকে কেন এই প্রতিশ্রুতি দিতে হলো? 

তাহলে আমরা কতটা এগোলাম?

আওয়ামী লীগকে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি তো আগের নির্বাচনগুলোতে দিতে হয়নি।

এ প্রসঙ্গে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্ধারিত নির্বাচনের আগে (যে নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত হয়নি বিএনপির একগুঁয়েমির কারণে) আওয়ামী লীগ খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে যে ৫ দফা চুক্তি করেছিল, তারও প্রথম শর্ত ছিল এটি। আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক মিত্র হেফাজতে ইসলামও তাদের ১৩ দফা কর্মসূচিতে এটিই প্রথম শর্ত আরোপ করেছিল। বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মবাদীদের নিয়ে হেফাজত গঠিতই হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার–ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতিমালা বাতিল করার জন্য।

দ্বিতীয় ঘটনা হলো, বিকল্পধারার সভাপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, যিনি আজ আওয়ামী লীগ জোটের শরিক। একসময় তিনি বলতেন, বিএনপির ভোটব্যাংক হলো মুসলিম মূল্যবোধ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী মানুষ; আর আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হলো ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সেক্যুলার মানুষ। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে তাঁর প্রচারিত ‘শাবাশ বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানটিও আওয়ামী লীগ নেতারা আরেকবার দেখে নিতে পারেন। বিএনপি গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যত না বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি বিষোদ্‌গার ছিল বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ওই একটি অনুষ্ঠানে।

আওয়ামী লীগ যখন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার অধিকার নেই বলে দাবি করে, তখন তাদের পাল্টা প্রশ্ন করতে হয়, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন আওয়ামী লীগ সরকার গত ১০ বছরে দলটি নিষিদ্ধ করল না?

২০১৩-১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত যে আগুন-সন্ত্রাস চালিয়েছে, ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি তার চেয়ে কোনো মাত্রায় কম সন্ত্রাস চালায়নি। সে সময় আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা হেফাজত সম্পর্কে কী কী বলেছেন এবং আজ কী বলছেন, পুরোনো কাগজ ঘেঁটে তা মিলিয়ে দেখলে সম্ভবত তাঁরা লজ্জাই পাবেন।

আমরা মনে করি, ওয়াহাবি মতবাদে বিশ্বাসী জামায়াতে ইসলামী কিংবা ধর্মান্ধ হেফাজত—এ দুটোর কেউই গণতন্ত্রের সুহৃদ নয়। কিন্তু কৌশলগত কারণে কাউকে কাছে টানা এবং কাউকে দূরে ঠেলে দেওয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করা যেতে পারে; তাতে গণতন্ত্র এককদমও এগোবে না। গণতন্ত্রের স্বার্থে সব সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তিকেই প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো, বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ৪ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, পুনর্বহাল সাবেক স্বৈরাচারী এরশাদ-প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রধর্ম নয়। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনা হলো, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা।