ইসি ইচ্ছে করেই 'ঘুমিয়ে আছে'

‘একটি মানসম্মত নির্বাচনের জন্য করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) এম হাফিজউদ্দিন খান, আতাউর রহমান ও মনজুর হাসান। গতকাল সকালে রাজধানীর বিস মিলনায়তনে।  ছবি: প্রথম আলো
‘একটি মানসম্মত নির্বাচনের জন্য করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) এম হাফিজউদ্দিন খান, আতাউর রহমান ও মনজুর হাসান। গতকাল সকালে রাজধানীর বিস মিলনায়তনে। ছবি: প্রথম আলো

সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুরোপুরি ব্যর্থ বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান। তাঁর ধারণা, ইসি ইচ্ছে করেই ‘ঘুমিয়ে আছে’। একটি মানসম্মত নির্বাচনের জন্য করণীয় শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ মন্তব্য করেন।
এ বৈঠকের আয়োজন করে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) মিলনায়তনে এ বৈঠক হয়। এতে রাজনীতিবিদ, সাবেক আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও ব্যবসায়ী নেতারা অংশ নেন।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, নির্বাচনের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করাসহ এখনো অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে। অথচ নির্বাচনের বাকি মাত্র ১১ দিন। দায়বদ্ধতা না থাকায় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস
হয়ে যাচ্ছে। এগুলো মেরামত করতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক মনজুর হাসান। তিনি বলেন, বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের চাপ ও হুমকিতে আছেন। এটি চরম উদ্বেগের। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং জরুরি ভিত্তিতে সহিংসতা বন্ধে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে এবং নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
প্রবন্ধে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা ও করণীয় তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে প্রচারের সময় ও নির্বাচনের দিন প্রত্যেক নাগরিক ও রাজনৈতিক দলের সম–অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, নির্বাচনকালীন প্রশাসনের ওপর ইসির পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে নির্বাচনী বিধিমালার প্রয়োগ, প্রার্থী, সমর্থক ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অন্যতম।

ইসির সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন
অনুষ্ঠানে সাবেক সচিব এ এইচ মোফাজ্জল করিম বলেন, প্রচার শুরুর পর থেকে যে সংঘাত ঘটছে, তা অনভিপ্রেত। এসব সংঘাত সহজেই দমন করা যায়। তিনি বলেন, ‘ইসি যদি শুধু আমরা খুব বিব্রতবোধ করছি, আমরা দুঃখিত, মর্মাহত এসব সুন্দর সুন্দর শরৎচন্দ্রীয় ভাষায় কথা বলে তাহলে হবে না। তাদের কাজ করে দেখাতে হবে।’
বিরোধী জোটকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দিতে সরকার মরিয়া চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, বিরোধীপক্ষের ওপর এত হামলার পরও ইসির টনক নড়ছে না। ইসির আদৌ অস্তিত্ব আছে কি না, বোঝা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
পর্যবেক্ষকদের জন্য নানা বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি উল্লেখ করে ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ বলেন, এতে ইসির আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি স্পষ্ট হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক চর্চা না করায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে না।

পরিস্থিতি সুখকর নয়
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘাতের ঘটনা তদন্ত করে যেকোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতাও ইসিকে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এটি প্রমাণিত না হলে দেশ আরও পিছিয়ে যাবে। এখন যা ঘটছে, তাতে ভালো কিছুর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সবার মধ্যে নির্বাচন নিয়ে একধরনের ভয় কাজ করছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবে কি না, তা নিয়ে ভাবছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইসি কোনো নির্দেশনা দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। দেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে, কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হচ্ছে না।
নির্বাচন নিয়ে মল্লযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। ঢাকা–১২ আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এই প্রার্থী বলেন, ক্ষমতায় যারা থাকে তারা অন্যদের কখনো ক্ষমতায় আসতে দিতে চায় না, এটি নিয়মে পরিণত হয়েছে।

সবার জন্য সমসুযোগ সৃষ্টি হয়নি

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এম এনামুল হক বলেন, সংঘাতের বিষয়গুলো নির্বাচনী তদন্ত কমিটির দেখার কথা। অথচ ইসি বলছে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবে। শুধু ক্ষমতা থাকলে হবে না, ইসির প্রতিটি সদস্য, প্রশাসন ও পুলিশ সদস্যদের বিবেক থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবাই যেন বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকেন।
সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার মুহাম্মদ জমির বলেন, ইসির যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তা করতে পারেনি। প্রার্থীরা আহত হচ্ছেন, এটি দুঃখজনক। অন্তত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে মনে হয় সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যাঁরা নতুন ভোটার, তাঁরা যেন ভোটের পরিবেশ নিয়ে আশ্বস্ত হন।
আগামী কয়েক দিন সবাই যেন সমান সুযোগ পান, তা নিশ্চিত করতে ইসির প্রতি আহ্বান জানান নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংগঠন ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান। তিনি বলেন, এই সময়ে যেন আর কোনো সহিংসতা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
আড়াই কোটি তরুণ ভোটার যদি শান্তিপূর্ণভাবে নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারেন, তাহলে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর তাঁদের আস্থাহীনতা তৈরি হবে বলে মন্তব্য করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ।
সিজিএসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আতাউর রহমান ঢালী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মামুন আহমেদ, জাপানিজ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ উপদেষ্টা আবদুল হক, সিজিএসের ভাইস চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ। বৈঠক সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।