জামায়াতের বিচার কেবলই মুখে মুখে

>

• মানবতাবিরোধী অপরাধ
• জামায়াতের বিচার ও নিষিদ্ধ করতে আইন সংশোধনের উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি
• মূল কারণ ‘রাজনৈতিক’

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর বিচার এবং দলটি নিষিদ্ধ করার কথা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলে এলেও বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

সাড়ে চার বছর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, অপরাধী সংগঠনের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের সংশোধনীর খসড়া শিগগিরই মন্ত্রিসভায় উঠবে। শেষ পর্যন্ত সেটা আর মন্ত্রিসভায় ওঠেনি। ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সংগঠনের বিচারকাজও শুরু করা যায়নি।

সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতের বিচারের জন্যই মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের সংশোধনীর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই সরকার সেটা বাস্তবায়ন বা জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কাজ শুরু করেনি।

ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলে ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের লাভ নেই। কারণ, নিষিদ্ধ করার পর জামায়াতের ভোট সব বিএনপির বাক্সেই যাবে। বরং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এই দল টিকে থাকলে এবং বিএনপির জোটে থাকলে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এই জোটকে ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের’ পৃষ্ঠপোষক আখ্যা দিয়ে চাপে ফেলার সুযোগ বজায় থাকবে।

অবশ্য অপরাধী সংগঠনের বিচার না হলেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারকাজ শুরু করে তা কার্যকর করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে গত ২৮ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। ফলে নিজেদের দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে পারছে না জামায়াত। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির ২১ জন নেতা জোটের শরিক বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন। আরও চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নিয়ে নির্বাচন করছেন।

এরই মধ্যে নিবন্ধন বাতিলের পরও জামায়াতের নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট হয়। এর ভিত্তিতে আদালত জামায়াতের নেতাদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা বাতিলের বিষয়ে করা আবেদন তিন দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দিয়েছেন। ইসির সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ২৪ ডিসেম্বর মধ্যে জামায়াতের প্রার্থীদের নিয়ে হাইকোর্টের রুলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার শুরুর পর ২০১৩ সালের আগস্টে সেই অপরাধীদের দল জামায়াতের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়। পরের বছর ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্তও করে মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থা। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধান নেই। এই অবস্থায় ২০১৪ সালে আইন মন্ত্রণালয় অপরাধী সংগঠনেরও শাস্তির বিধান রেখে আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। প্রস্তাবিত ওই সংশোধনীতে ট্রাইব্যুনালস আইনের সংশ্লিষ্ট ধারায় ‘ব্যক্তি’ শব্দটির পর ‘অথবা সংগঠন’ সন্নিবেশ করা হচ্ছে। আরেকটি ধারায় ‘দায়’ শব্দটির পরিবর্তে ‘অথবা সাংগঠনিক দায়’ এবং অপর ধারায় ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি’ পরিবর্তে ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংগঠন’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়। এ ছাড়া সংগঠন হিসেবে দোষী প্রমাণিত হলে ওই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার বিধান রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এরপর নিষিদ্ধ হতে পারে এমন আশঙ্কায় জামায়াতও নতুন নামে আত্মপ্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও বের হয় বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু নিষিদ্ধ না হওয়ায় তাদের সে পথে যেতে হয়নি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দলটি এখনো রাজনীতিতেও সক্রিয়। তবে আইন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সংগঠনের বিচারের উদ্যোগ আটকে যায়নি। বলতে পারেন, প্রক্রিয়াধীন আছে। হয়তো নির্বাচনে চলে আসায় বা আরও নানা কারণে সেটি এখন করা যায়নি।

এর আগে ট্রাইব্যুনালস আইনের তিন দফা সংশোধন করা হয়েছে। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনের প্রথম দফা সংশোধনীতে কয়েকটি স্থানে পরিবর্তন এনে মূলত হালনাগাদ করা হয়েছিল। ২০১২ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীতে আসামির অনুপস্থিতিতে তাঁকে পলাতক ঘোষণা করে বিচার এবং এক ট্রাইব্যুনাল থেকে আরেক ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তরের বিধান যুক্ত করা হয়। সর্বশেষ সংশোধনী আনা হয় ২০১৩ সালে। কেবল দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হয়নি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত পর্যায়ে গিয়েও বিষয়টি থেমে যায়। এ জন্য তিনি সাবেক একজন প্রধান বিচারপতির ভূমিকারও সমালোচনা করেন। শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘শুধু জামায়াত নয়, আলবদর, আলশামস—সবারই বিচার করতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি আবার ক্ষমতায় আসে, তাহলে অবশ্যই এই কাজ করতে হবে। এখানে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।’