ডিগবাজি আর আনুগত্যে বারবার ভোটযুদ্ধে তাঁরা

>

• নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অনেকগুলো নাম ঘুরেফিরে এসেছে
• পাওয়া যায় দলবদল আর একনিষ্ঠতার চিত্রও
• কেউ কেউ ডিগবাজি খেয়েছেন
• কেউ থেকে গেছেন দল-প্রতীকের প্রতি একনিষ্ঠ

এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের মধ্যে অন্তত ১২ জন ১৯৭০–এর দশকের গোড়া থেকে নির্বাচনী মাঠে আছেন। অন্তত ৫০ জন আছেন যাঁরা গত পাঁচ দশকে পাঁচ বা তারও বেশিবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ ডিগবাজি খেয়েছেন, কেউ থেকে গেছেন দল-প্রতীকের প্রতি একনিষ্ঠ।

নৌকা, ধানের শীষ, লাঙ্গল, কুঁড়েঘর, কাস্তে-হাতুড়ি; কখনো বা দাঁড়িপাল্লায় ভোলবদলের পাশাপাশি একনিষ্ঠতার ঐতিহ্য এবং পারিবারিক পরম্পরায় প্রার্থিতার নজিরও কম নয়। চার-পাঁচটি বা তার বেশি নির্বাচনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, প্রার্থীদের বড় অংশ একই ‘ঘরানা’ বা ধারার বিভিন্ন দল বদল করে চলেছে। আবার দলত্যাগী নেতাদের ঘরে ফেরার নজিরও আছে।

বাংলাদেশের জন্মের ভিত্তিতে থাকা সত্তর সালের প্রাদেশিক নির্বাচনসহ গত ১১টি জাতীয় নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানের প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পেয়েছে প্রথম আলো। কিছু তালিকায় অল্পস্বল্প ফাঁক থাকা সত্ত্বেও একটি সার্বিক চিত্র উঠে এসেছে এতে।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জোট মিলিয়ে এবার অন্তত সাতজন প্রার্থী আছেন, যাঁরা ১৯৭০ সালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে জিতেছিলেন। অন্তত পাঁচজন প্রার্থী যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে।

প্রথম সাতজনের মধ্যে আমির হোসেন আমু, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন জিতেছিলেন প্রাদেশিক পরিষদে। আর তোফায়েল আহমেদ ও অধ্যাপক আবু সাইয়িদ নির্বাচিত হন জাতীয় পরিষদে। এই সাতজন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদেও নির্বাচিত হন। সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের ঘরের মানুষ। চারজন এখনো তা-ই আছেন। শাহ মোয়াজ্জেম ও আবু সাইয়িদ ঘর শুধু নয়, মেরুই পাল্টে ফেলেছেন।

আবদুল্লাহ আল নোমান, রাশেদ খান মেনন, শাজাহান খান, আলী আশরাফ ও এ কে এম শাহজাহান কামাল—এবারকার এই পাঁচজন প্রার্থীও প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। শেষের দুজন বরাবর আওয়ামী লীগের হয়ে লড়ছেন। আবদুল্লাহ আল নোমান, একেবারে বিপরীত মেরুতে চলে গেছেন। উল্টো পথে হেঁটেছেন বর্তমান নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। ১৯৭৩ সালে তিনি জাসদের হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু সপ্তম সংসদ নির্বাচন থেকে তিনি নৌকায় ভিড়েছেন। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগই তাঁর দল।

গত ১০টি জাতীয় নির্বাচনের ৮টিতে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছে। আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ সব কটিতেই ছিলেন। তোফায়েল সাংসদই হয়েছেন সাতবার। সাতবার নির্বাচন করে পাঁচবার আওয়ামী লীগের সাংসদ হয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। একনিষ্ঠ সমর্থকদের এই দলে লতিফ সিদ্দিকীও আছেন, তবে চলতি মেয়াদে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছিলেন আর দলীয় মনোনয়নও পাননি। এবার তিনি ‘একলা চলো’ নীতি নিয়েছেন।

বিএনপি প্রথম নির্বাচন করে ১৯৭৯ সালে, দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের জন্য। তাদের অন্তত সাতজন এবারও ভোটের মাঠে হাজির। চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী ও শাহজাহান চৌধুরী (কক্সবাজার) এখনো একই ছাতার নিচে আছেন। সরদার এ কে এম নাসিরুদ্দিন, মওদুদ আহমদ আর আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। রেদোয়ান আহমেদ নতুন দলই খুলে বসেছেন। তবে তাঁরা কেউ ধারা পাল্টাননি।

দলে-জোটে ডিগবাজি
১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় দল ছিল আওয়ামী লীগ। বলার মতো আর ছিল বামধারার দলগুলো। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ও এরশাদ আমলে দল ভেঙে দল গড়ার প্রক্রিয়া প্রকট হয়। জন্ম নেয় বিএনপি ও জাতীয় পার্টি (জাপা)। শুরু হয় অনেক চেনামুখের দলবদল, ক্রমে যার সঙ্গে যোগ হয়েছে জোটবদলের খেলা। ডিগবাজির পরিসর হাল চষা, ধান কাটা আর নৌকায় ফসল তোলার মধ্যে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, আদর্শহীনতার সংস্কৃতির পাশাপাশি ব্যক্তিগত লাভের বিষয়টি ডিগবাজিতে বড় ভূমিকা রাখে। আর রাজনৈতিক দলগুলোরও থাকে জেতার জন্য নানা সমীকরণ।

লাঙ্গল, ধানের শীষ আর নৌকা—তিন প্রতীকেই ভোট খেলেছেন হাতে গোনা কয়েকজন। প্রথমেই আসে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের কথা। একসময়ের এই ছাত্রলীগ নেতা দেশের প্রথম সংসদে ছিলেন চিফ হুইপ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোড় ঘুরে যোগ দেন হত্যাকারীদের বসানো রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের ডেমোক্রেটিক লীগে। জিয়া হত্যার পর এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে শাহ মোয়াজ্জেম হাতে তুলে নেন লাঙ্গল। একসময় তিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব হন, হন উপপ্রধানমন্ত্রীও। ২০০৬ সালে তৃতীয় ডিগবাজি দিয়ে বনে যান বিএনপির। কিন্তু এ দলের হয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে হেরে যান। এবারও তাঁর হাতে ধানের শীষ, মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে।

সাবেক স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরীরও একই অভিজ্ঞতা আছে। ময়মনসিংহের এই নেতা বিএনপির হয়ে সাংসদ হন ১৯৭৯ সালে। ১৯৮৬ ও ’৮৮ সালে হলেন জাতীয় পার্টির সাংসদ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে নৌকায় উঠেছিলেন, কিন্তু সংসদে পৌঁছাতে পারেননি। তবে এরপর আমরণ নৌকা ছাড়েননি।

মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রথম সংসদে ছিলেন নৌকায়। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ এই নেতা জিয়াউর রহমানের আমলে দল ভেঙে বেরিয়ে আসেন। দলের নামের পাশে বন্ধনীতে নিজের নাম দিয়ে মই মার্কা নিয়ে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন। তারপর এরশাদ আমলে জাপায় যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। পরের তিনটি নির্বাচন তিনি লাঙ্গল নিয়েই করেছেন। কিন্তু ২০০১ সালে নৌকায় প্রত্যাবর্তন করেন, যদিও আর নির্বাচন করেননি।

১৯৭০ থেকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক আবু সাইয়িদের প্রায় পাঁচ দশক কাটল যাওয়া আর ফেরার দৌড়াদৌড়িতে। ১৯৮৩ সালে আবদুর রাজ্জাক আওয়ামী লীগ ছেড়ে বাকশাল নামে দল গড়লে সাইয়িদ তাঁর সঙ্গী হন। বাকশালের কাস্তে হাতে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন করে জামায়াতের মতিউর রহমান নিজামীর কাছে হেরে যান। তারপর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে নৌকায় চড়ে নিজামীকে হারিয়ে ১৯৯৬-এর জুনে সপ্তম সংসদে যান।

কিন্তু ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাইয়িদ ‘সংস্কারপন্থী’ তকমা পেলে দল পরবর্তী দুই নির্বাচনে আর তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি। এবারও দলে বিফল; তাই যোগ দিয়েছেন গণফোরামে আর ভোটযুদ্ধে নেমেছেন ধানের শীষ হাতে।

রাশেদ খান মেনন ও আবদুল্লাহ আল নোমান দুজনই ’৭৩-এর সংসদে যেতে চেয়েছিলেন ভাসানী ন্যাপের হয়ে। পারেননি। মেনন ১৯৭৯ সালে সম্মিলিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ছাতায় বরিশালের বাকেরগঞ্জ-৯ আসনের সাংসদ হন। তারপর বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি গড়ে পঞ্চম সংসদ নির্বাচন থেকে একটানা ভোটের মাঠে আছেন তিনি। তবে জোটের রাজনীতিতে এবার তাঁর প্রতীক নৌকা। আর নোমান গিয়েছেন বিএনপির ঘরে।

কর্নেল (অব.) অলি আহমদ পঞ্চম থেকে অষ্টম সংসদ পর্যন্ত ছিলেন বিএনপির সাংসদ ও মন্ত্রী। ২০০৬ সালে নতুন দল এলডিপি গড়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে। এক বছরের মাথায় মহাজোট ছাড়েন। ২০১২ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটে ঢুকেছেন। তবে এবারের নির্বাচনে লড়ছেন ঐক্যফ্রন্টের হয়ে, নিজের দলীয় প্রতীকে।

যুদ্ধাপরাধের জন্য ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী প্রথম সাংসদ হয়েছিলেন ১৯৭৯ সালে, মুসলিম লীগ থেকে হাতে হারিকেন নিয়ে। এরপর এরশাদের আমলে তিনি লাঙ্গল ধরে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জিতে মন্ত্রী হন। পরের বছর নিজেই গঠন করেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)। সেই দল থেকে পঞ্চম সংসদে নির্বাচিত হন। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি জেতেন, তবে তখন তিনি বিএনপির। বিএনপির হয়েই তাঁর সাংসদ জীবনের ইতি, নবম সংসদে। তাঁর ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এই পরম্পরা ধরে রেখেছেন।

বাংলাদেশের প্রথম নারী সাংসদ সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজও মুসলিম লীগের হয়ে নির্বাচিত হন ১৯৭৯ সালে, উপনির্বাচনে। আগে জিতেছিলেন একই দলের খান এ সবুর। রাজিয়া ফয়েজ ১৯৮৭ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রী হন। ১৯৯১ ও ’৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির হয়ে অংশ নেন। পরে ২০০৮ সালে বিএনপিতে যোগ দিয়ে আমৃত্যু সেই দলে ছিলেন।

বিএনপিতে নির্বাচনী যাত্রা শুরু করে আশির দশকের গোড়ায় মওদুদ আহমদ জাপার প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হন। তারপর তিনি এরশাদের প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হন। তবে অষ্টম সংসদ থেকে (২০০১) মওদুদ তাঁর পুরোনো ঘরে ফিরেছেন। এবারও তাঁর হাতে ধানের শীষ।

বিএনপি থেকে আশির দশকের মাঝামাঝিতে জাপায় গিয়ে থিতু হয়েছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটভুক্ত হয়ে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) থেকে আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপিতে গিয়ে সাংসদ হওয়ার বেশ কিছু নজির আছে। ১৯৯১ সালে সিপিবির প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হয়েছিলেন বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। এরপর থেকে এবার পর্যন্ত তিনি আওয়ামী লীগের ভোটযোদ্ধা। আবার পঞ্চম সংসদে সিপিবির সাংসদ পঞ্চগড়ের মোজাহার হোসেন পরের নির্বাচনগুলোয় লড়েছেন বিএনপির হয়ে। এবার তিনি মাঠে নেই।

এবার জোটের রাজনীতির তালেগোলে দল না বদলেও প্রতীক বদল দেখা যাচ্ছে। যেমন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ এস এম আকরাম এবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচনের মাঠে আছেন। মার্কা তাঁর ধানের শীষ। একই অবস্থা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম আবদুর রব, মোস্তফা মোহসীন মন্টুর মতো বেশ কিছু রাজনীতিকের।

জামায়াতের প্রার্থীদের মধ্যে দলবদলের নজির কম। তবে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করার পর এবার জোটের সুবাদে জামায়াতের ২১ জন প্রার্থী বিএনপির ধানের শীষে আশ্রয় নিয়েছেন। আরেকজন আছেন স্বতন্ত্র, যিনি বিএনপির সমর্থন পেয়েছেন।

সাবেক রাষ্ট্রপতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দীর্ঘদিনের আসনে এবার নির্বাচন করছেন তাঁর ছেলে মাহী বি চৌধুরী। বি চৌধুরীর মতোই তাঁর ছেলেও নতুন দল বিকল্পধারা গঠনের আগে বিএনপি করতেন। কিন্তু জোটের হিসাবনিকাশে এবার তিনি লড়ছেন নৌকায় চড়ে।

জাতীয় পার্টির পুরোনো সাংসদ ফজলে রাব্বী মিয়া আওয়ামী লীগের সাংসদ হয়ে যান ২০০১ সালে। তিনি বর্তমান সংসদের ডেপুটি স্পিকার। এবারও মাঠে আছেন।

বিএনপির সাবেক মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান সত্তরের জাতীয় পরিষদে নৌকা নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটে। তারপর তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। এরশাদের আমলে গঠন করেন জনতা দল। এরশাদের পতনের পর নির্বাচনে হারেন। অতঃপর বিএনপিতে ফিরে দুবার সাংসদ হন। তাঁর মৃত্যুর পর এবার তাঁর আসনে ভোট করছেন মেয়ে শামা ওবায়েদ।

সত্তর দশকের গোড়ায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত নির্বাচন করেছিলেন ন্যাপ (ওয়ালী) এবং ন্যাপের (মোজাফফর) হয়ে। ’৭০-এর প্রাদেশিক পরিষদে জেতেন আর ’৭৩-এ দ্বিতীয় হন। ১৯৯১ সালে তিনি ছিলেন গণতন্ত্রী পার্টির প্রার্থী। অবশেষে তিনি থিতু হন আওয়ামী লীগে, ১৯৯৬ সাল থেকে। তাঁর মৃত্যুর পর এবার সেই আনুগত্যের সুতো তাঁর স্ত্রী জয়া সেনগুপ্তার হাতে।

রাজনৈতিক পরম্পরা

পাঁচ দশকে দলনিষ্ঠ ভোটযোদ্ধার সংখ্যাও কিন্তু কম না। আওয়ামী লীগ ঘরানায় এমন কয়েকজনের নাম করতে গেলে শেখ হাসিনা ও তাঁর স্বজনদের নাম চলেই আসে। অনুগত লাগাতার ভোটযোদ্ধাদের তালিকাও দীর্ঘ। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির এমন তালিকা কিছুটা ছোট।

দলনিষ্ঠতার আরেক নজির পারিবারিক পরম্পরা। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কান্ডারি হিসেবে পরিচিত জিল্লুর রহমান সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদ থেকে শুরু করে একটানা ২০০৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচন করেছেন। সাবেক এই রাষ্ট্রপতির আসনে এখন নির্বাচন করছেন তাঁর ছেলে নাজমুল হাসান।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সত্তর সালের জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনিও ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভোটের মাঠে ছিলেন। ২০১৩ সালে প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হলে তাঁর জায়গায় হাল ধরেন ছেলে রেজোয়ান আহম্মেদ।

মাদারীপুরের ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ’৭০ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রার্থী থেকেছেন। তাঁর মৃত্যু হলে হাল ধরেছেন ছেলে নুর-ই-আলম চৌধুরী। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী সত্তরের নির্বাচন থেকে আমৃত্যু আওয়ামী লীগের ভোটের মাঠে ছিলেন। তাঁর পরম্পরায় এবারও মাঠে আছেন ছেলে সাইফুজ্জামান চৌধুরী।

ময়মনসিংহের আলতাফ হোসেন ১৯৭৩ সালে ন্যাপ (মো.) থেকে হেরে যান। ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত সেখানে নির্বাচনে নৌকার কান্ডারি ছিলেন। এখন সে দায়িত্ব তাঁর ছেলে ফাহমি গোলন্দাজের হাতে।

আওয়ামী লীগে এমন উদাহরণ অনেক। অন্য দলেও আনুগত্যের বংশপরম্পরা আছে, তবে কম। সাবেক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মিজানুর রহমান শেলী মনে করেন, আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে দলনিষ্ঠতা বেশি, কারণ দলটি সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেই গড়ে উঠেছে। তিনি মনে করেন, জিল্লুর রহমান বা আবদুল হামিদের মতো অন্য নেতারা দলে মূল্যায়ন পেয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে একটি আদর্শ নিয়ে কাজ করার প্রবণতা ছিল।