ভোটারদের মনে নানা প্রশ্ন, শঙ্কা

ময়মনসিংহ শহরের নতুন বাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে গতকাল সোমবার দুপুরে কথা হচ্ছিল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁর বাড়ি জেলার তারাকান্দা উপজেলায়। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি বলেন, যদি নির্বাচন সুষ্ঠু হয় তাহলে জেলার ১১টি আসনের ফলাফল হবে এক রকম। আর যদি সুষ্ঠু না হয় তাহলে ফল হবে আরেক রকম। সবকিছুই নির্ভর করছে আসলে নির্বাচনটা কেমন হবে, তার ওপর। সংসদ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার কথাও বলেছেন তিনি।

ভোটারদের মনে নানা প্রশ্ন ও আশঙ্কা থাকলেও প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, এই জেলায় সহিংসতা তুলনামূলক কম। প্রচার চালাতে খুব বেশি অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে না প্রার্থীদের।

তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, নির্বাচনের পরিবেশ এখনো শান্তিপূর্ণ নয়। নেতা–কর্মীরা চাপে ও ভয়ে আছেন। সেনাবাহিনী মোতায়েন হওয়ায় পরিস্থিতি পাল্টাবে বলে আশা করছেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এই জেলায় তাঁরা ভালো করবেন।

অন্যদিকে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী আজাদ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, শুরুতে কিছু আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দল থাকলেও এখন তা কাটিয়ে ওঠা গেছে। ময়মনসিংহে বরাবরই নৌকার অবস্থা ভালো। এবারও নৌকার পালে হাওয়া লেগেছে।

 বিএনপির প্রার্থী নিয়ে নাটকীয়তা, সুবিধায় জুয়েল আরেং

সীমান্তঘেঁষা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ–১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ জুয়েল আরেং। তাঁর বাবা প্রয়াত প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন। এই আসনে শুরুতে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন চারজন। পরে চূড়ান্তভাবে দলীয় মনোনয়ন পান হালুয়াঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আলী আজগর। কিন্তু ঋণখেলাপির কারণে তাঁর মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়। বিএনপি একেবারে শেষ পর্যায়ে সাবেক সাংসদ আফজাল এইচ খানকে দলের প্রতীক বরাদ্দ দেয়। কিন্তু তিনি নির্ধারিত সময়ের পর রিটানিং কর্মকর্তা ও ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতীক বরাদ্দের দলীয় চিঠি দিলে তা গ্রহণ করা হয়নি। এ কারণে এই আসনে প্রার্থীশূন্য হয়ে পড়ে দলটি।

আদালতের নির্দেশে গত রোববার আফজাল এইচ খানকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয় বলে প্রথম আলোকে জানান জেলা প্রশাসক সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস।

জুয়েল আরেং গারো সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায় ভোটের লড়াইয়ে কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাবেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা মনে করেন। কারণ, এই আসনে গারোদের ভোট আছে ৭০ হাজারের মতো।

 ময়মনসিংহ–২ আসনে চাপে বিএনপি

ফুলপুর ও তারাকান্দা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ–২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ শরীফ আহমেদ। এখানে বিএনপির প্রার্থী সাবেক সাংসদ শাহ শহীদ সারোয়ার। প্রচার শুরু হওয়ার পর বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের পর মামলা ও গ্রেপ্তারের কারণে চাপে পড়ে বিএনপি। এরপর থেকে দলটি বড় আকারে প্রচারণা চালাতে পারছে না। নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা ভয়ে আছেন।

 ময়মনসিংহ–৩ আসনে লড়াই

গৌরীপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ–৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ নাজিম উদ্দিন আহমেদর সঙ্গে লড়াই করছেন বিএনপির প্রার্থী প্রকৌশলী এম ইকবাল হোসেইন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এখানে এই দুই প্রার্থীর মধ্যে লড়াই জমবে।

বিএনপির প্রার্থী ইকবাল হোসেইন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অসমতল মাঠের চূড়ান্ত পর্যায়ে আছেন। তাঁকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষ থেকে হুমকি–ধমকি দেওয়া হচ্ছে। নেতা–কর্মীদের নামে মামলা ও হয়রানি হচ্ছে। এসব বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে অভিযোগ করেও সমাধান পাচ্ছেন না। তবে যতই নিগৃহীত করা হচ্ছে, ভোটারদের পক্ষ থেকে তত বেশি সাড়া পাচ্ছেন। তাঁর দাবি, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনিই জিতবেন।

আর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেছেন, শুরুতে প্রার্থিতা নিয়ে দলীয় কোন্দল থাকলেও এখন সবাই দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন।

 হঠাৎ বিএনপির বড় জমায়েত

সদর উপজলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ–৪ আসন জেলার রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবা হয়। কারণ, এখান থেকেই জেলার পুরো রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ হয়। জাতীয় পার্টির কো–চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ এখানে মহাজোটের প্রার্থী। শুরুতে আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা তাঁর পক্ষে এক হয়ে নামেননি। আওয়ামী লীগের নিজেদের দলীয় প্রার্থী না থাকায় বিএনপির প্রার্থী আবু ওয়াহাব আকন্দ ও তাঁর সমর্থকেরা বড় কোনো বাধার মুখেও পড়েননি। কিন্তু গত দুই–তিন ধরে জেলা আওয়ামী লীগের দুটি অংশের নেতা–কর্মীরা রওশন এরশাদের পক্ষে এক হয়ে মাঠে নেমেছেন। এরপর চিত্র পাল্টাতে থাকে।

ময়মনসিংহ মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, পাঁচ দিন ধরে বাসায় থাকতে পারছেন না তিনি। নতুন তিনটি মামলাসহ তাঁর নামে মোট ৩৬টি মামলা দেওয়া হয়েছে।

যদিও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা অভিযোগ করছেন, হঠাৎ করেই বিএনপি সহিংস কর্মকাণ্ড করছে। এ জন্যই মামলা হচ্ছে।

গতকাল শহরের নতুন বাজার এলাকায় বিএনপি প্রার্থীর সমর্থনে কয়েক হাজার নেতা–কর্মী জমায়েত হন। নতুন বাজারে দাঁড়িয়ে কথা হয় কয়েকজন নেতা–কর্মীর সঙ্গে। তাঁরা বলেন, সেনাবাহিনী মোতায়েন হওয়ায় তাঁদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি কাজ করছে।

 অন্যান্য আসনের চিত্র

মুক্তাগাছা উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ–৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক সাংসদ কে এম খালিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনপির মোহাম্মদ জাকির হোসেন। বিএনপির অভিযোগ, হামলা ও বাধার কারণে প্রচারে পিছিয়েছে তারা। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বলেন, বিএনপি উল্টো আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করেছে। তাদের হামলায় দলের এক কর্মী গুরুতর আহত হয়েছেন। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও তাঁরা ধৈর্য্য ধরছেন।

ফুলবাড়িয়া নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ–৬ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মোসলেম উদ্দিন পাঁচবারের সাংসদ। আবার বিএনপির প্রার্থী সাবেক সাংসদ শামছুদ্দিন আহমেদেরও এলাকায় শক্ত অবস্থান রয়েছে। এখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে আছেন কে আর ইসলাম। জাতীয় পার্টিও মাঠে থাকায় অস্বস্তি রয়েছে আওয়ামী লীগে।

ময়মনসিংহ–৭ (ত্রিশাল) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রুহুল আমীন মাদানী। বিএনপির প্রার্থী মাহাবুবুর রহমান। তিনি গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের লোকজন নিজেরাই তাদের অফিস ভাঙচুর করে বিএনপিকে অভিযুক্ত করছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর দাবি, সহিংসতা করে বিএনপি নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করছে।

ময়মনসিংহ–৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নেই। এখানে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পাটির ফখরুল ইমাম। তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে আওয়ামী লীগের একটি অংশের মধ্যে ক্ষোভ আছে। তাঁর বিরুদ্ধে উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হলেও আদালতে তাঁর প্রার্থিতা স্থগিত হয়। এখানে বিএনপিরও দলীয় প্রার্থী নেই। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে গণফোরামের প্রার্থী এ এইচ এম খালেকুজ্জামান ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। ফলে এই আসনে শেষমেশ কী হয়, তা বলা যাচ্ছে না।

নান্দাইল নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ–৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুল আবেদীন খানের বেশি ভয় ছিল দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) আবদুস সালামকে নিয়ে। কিন্তু তিনি নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় কিছুটা স্বস্তিতে আছেন। যদিও এই আসনে বিএনপির শক্ত প্রার্থী সাবেক সাংসদ খুররম খান চৌধুরী।

ময়মনসিংহ-১০ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী এলডিপির সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সাংসদ ফাহমী গোলন্দাজ ‘শক্তিতে’ এগিয়ে। স্থানীয় নেতাদের অনেকের মূল্যায়ন, এই আসনে যে পরিস্থিতি তাতে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী বেশির ভাগ কেন্দ্রে হয়তো নির্বাচনী এজেন্ট দিতে পারবেন না।

ভালুকা উপজেলা নিয়ে গঠিত ময়মনসিংহ–১১ আসনে এবার নতুন প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। একাধিকবারের সাবেক সাংসদ আমানুল্লাহকে বাদ দিয়ে উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কাজিমউদ্দিন আহম্মেদকে মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। এই আসনে বিএনপির প্রার্থী ফখরউদ্দিন আহমেদ। বিএনপির অভিযোগ, তফসিল ঘোষণার পর পুলিশের হয়রানি ও মামলার কারণে তারা ঠিকমতো প্রচারণা চালাতে পারছে না।