চট্টগ্রামে এত নাশকতা টেরই পাননি বাসিন্দারা

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগর ও জেলার ৩২ থানায় নাশকতার অভিযোগে মামলা হয়েছে ২৩২টি। এর মধ্যে শুধু অক্টোবর মাসেই হয়েছে ১০৩ মামলা। এই হিসাবে প্রতিদিন তিন থেকে চারটি ককটেল বিস্ফোরণ কিংবা নাশকতার ঘটনা ঘটলেও নগরবাসী টের পাননি। গণমাধ্যমেও এসব খবর আসেনি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের অক্টোবরে ১০৩টি ছাড়াও সেপ্টেম্বরে ৪৭ ও নভেম্বরে ২৫টি নাশকতার মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াত ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের আসামি করেছে পুলিশ। এজাহারে নাম না থাকলেও অনেককে সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর ওই সব মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। আসামি হওয়া থেকে রেহাই পাননি মৃত ও কারাবন্দীরাও। তবে গত বছরের কোনো মাসেই এ ধরনের নাশকতার মামলা আদালতের নিবন্ধন শাখায় পাওয়া যায়নি।

এদিকে ধরপাকড় বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। রাত কাটাচ্ছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। সর্বশেষ ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৪২৮। গত এক মাসেই বন্দী বেড়েছে ৩ হাজার। গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বন্দী ছিল ৫ হাজার ৬০০।

এজাহারে ককটেল বিস্ফোরণ ও বিস্ফোরক উদ্ধারের কথা বলা হয়েছে এমন ১০টি স্থানে গিয়ে ওই সব ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি। গত ২৮ অক্টোবর নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার শেরশাহ ফকিরপাড়ায় একটি পোশাক কারখানার সামনে রাস্তার ওপর রাত ৩টা ২৫ মিনিটের দিকে বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি, জনমনে ভীতির সঞ্চার, সম্পদের ক্ষতিসাধন, অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করার অপরাধে ৩৫ জন বিএনপির নেতা-কর্মী এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। বাদী বায়েজিদ বোস্তামী থানার উপপরিদর্শক বেলাল হোসাইন। গত রোববার দুপুরে ঘটনাস্থলে গেলে কয়েকজন দোকানদার জানান, সেদিন রাতে তাঁরা দোকানের ভেতর ছিলেন। কোনো শব্দ শোনেননি। মামলা হয়েছে কি না জানেন না। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন উপপরিদর্শক রেজাউল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত চলছে। শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাবে না।

গত ২ নভেম্বর রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে নগরের পাঁচলাইশ থানার মুরাদপুর এন মোহাম্মদ প্লাস্টিক কারখানা এলাকায় এবং পরদিন ৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ১২টায় বায়েজিদ বিজিসি ট্রাস্ট এলাকায় রাস্তায় পাশে ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে দুটি মামলা করে পুলিশ। গত রোববার বিকেলে দুটি স্থানে গিয়ে আশপাশের দোকানিদের জিজ্ঞেস করলে তাঁরা কিছুই জানেন না বলে জানান। এক দোকানি বলেন, ‘শুনেছি, ঘটনা না ঘটলেও পুলিশ মামলা করেছে।’

চট্টগ্রাম-৯ কোতোয়ালি আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী শাহাদাত হোসেন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতিও। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় নাশকতার অভিযোগে ৩০টি মামলা ছিল। সব কটিতে জামিনে ছিলেন। গত ৭ নভেম্বর তাঁকে ঢাকার সিএমএম আদালত এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ। পরে একে একে তাঁর নামে যোগ হতে থাকে আরও ১১টি মামলা।

পুলিশ সূত্র জানায়, গত ২১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ১৪ দিনে শাহাদাতের বিরুদ্ধে নগরের বিভিন্ন থানায় ১১টি মামলা করে পুলিশ। সব মামলার এজাহার অভিন্ন। শুধু ঘটনার সময় ও তারিখ ভিন্ন। কথিত চারটি ঘটনাস্থলে গিয়ে নাশকতার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা বেশির ভাগ মামলা পরিচালনা করছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহমদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোনো ঘটনা না ঘটলেও গত সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘গায়েবি’ মামলা করে রাখে পুলিশ। নির্বাচনী প্রচারণায় যাতে নেতা-কর্মীরা অংশ নিতে না পারেন, সে জন্য এসব মামলায় গ্রেপ্তার করছে পুলিশ। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, গ্রেপ্তারের সংখ্যাও বাড়ছে। 

কারাবন্দী ও মৃত ব্যক্তিও আসামি

চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া থানার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন। পরিবারের সদস্য ও স্থানীয় লোকজন জানান, ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনি। কোনো পদে না থাকলেও তিনি বিএনপির কর্মী ছিলেন। তাঁকে গত ১০ অক্টোবর বাকলিয়ার রাজাখালী মোড়ে ককটেল ছুড়ে মারতে দেখেছে পুলিশ। এ কারণে জসিমসহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়েছে। এই মামলায় জব্দ তালিকায় থাকা দুজন সাক্ষী হলেন স্থানীয় আলী আকবর ও মো. হারুন। দুজনই জানিয়েছেন, তাঁরা ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বাকলিয়া থানার পুলিশ অবশ্য ভুল করে মৃত ব্যক্তিকে আসামি করেছে বলে আদালতকে লিখিতভাবে জানিয়েছে।

১২ ডিসেম্বর রাতে নগরের ডবলমুরিং থানার পূর্ব মুহুরীপাড়া ছোট মসজিদ গলির পাশে ককটেল ছোড়ার ঘটনায় করা মামলায় নগরের উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক এস এম ফরিদুল আলমকে আসামি করে ডবলমুরিং থানার পুলিশ। অথচ তিনি নাশকতার মামলায় গত ২৬ অক্টোবর থেকে কারাগারে আছেন। ১৫ ডিসেম্বর প্রথম আলোতে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ডবলমুরিং থানার পুলিশ মামলার এজাহার থেকে ফরিদুলের নাম বাদ দিতে আদালতে লিখিতভাবে আবেদন করে।

নাশকতার মামলা সম্পর্কে নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিছু বলতে রাজি হননি। রাজনৈতিক কারণে এসব মামলা হয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে পুলিশকে কাজ করা উচিত নয়। এই সংস্কৃতি গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়।