১০ বছরে নারীরা কী পেল?

বর্তমান সরকার দুই মেয়াদে ১০ বছর ক্ষমতায় আছে। তবে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিভিন্ন ধর্মের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও সনদের সংরক্ষিত ধারা প্রত্যাহার, বৈষম্যমূলক আইন সংশোধনের মতো বিষয়গুলোতে হাতই দেয়নি সরকার। তবে আওয়ামী লীগ ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার করেছিল।

নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার হিসেবে এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক। তবে প্রত্যাশা পূরণে অনেক ক্ষেত্রেই হোঁচট খেতে হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সরকারের হাত না দেওয়া বা মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নীরবতা ছিল হতাশাজনক।

নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার করলেও ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করাসহ বিভিন্ন কথা বলে তা বাস্তবায়ন করেনি। যদিও সিডও সনদে ধারা ২ ও ১৬ (১) (গ) তে বাংলাদেশ সরকারের সংরক্ষণসহ অনুসমর্থন রয়েছে।

দুই মেয়াদে নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে বিভিন্ন বিষয়ে নীরবতায় বৈশ্বিক অঙ্গনেও সরকারকে জবাবদিহি করতে হয়েছে বারবার। তবে প্রতিবারই সরকার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। ২০১৫ সালে সিডও কমিটিকে জমা দেওয়া অষ্টম সাময়িক প্রতিবেদনে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়—সিডও বাস্তবায়নে, বিশেষ করে নারী-পুরুষের সমতা তৈরির অনেক ক্ষেত্রেই ‘সমাজ’ এখনো প্রস্তুত নয়। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, সিডও সনদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়েই ধর্মীয় নেতারা সম্মত নন। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মীয় নেতারা একমত না হলে এটি করা কঠিন। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের বিষয়ে নারীদের রাজনৈতিক জ্ঞান ও দক্ষতা কম। অথচ ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৫০টি এবং পরোক্ষভাবে মনোনয়নের মাধ্যমে নারী সাংসদ ঠিক করার প্রক্রিয়া বহাল রাখে সরকার। চলতি বছরের গত ৮ জুলাই এ নারী আসনে মনোনয়নপদ্ধতি বহাল রেখে সময়সীমা ২৫ বছরের জন্য বৃদ্ধি করা হয়। অথচ ২০১৫ সালে সিডও কমিটির কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে সরকার উল্লেখ করে, এ ধরনের বিষয়গুলো বাস্তবায়নে আরও সময়ের প্রয়োজন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকিও প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধর্মীয় এবং সামাজিক নানান বিষয় বিবেচনায় নিয়েই কাজ করতে হয় সরকারকে। মানুষ ধর্মভীরু। আবার ধর্মের অপব্যাখ্যাও দেওয়া হয়। মানুষকে সচেতন করে কোনো কিছু করা সম্ভব হলে তা টেকসই হয়। সরকার মানুষকে সচেতন করার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।’ তিনি বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। হতাশার কিছু নেই, পর্যায়ক্রমে সব কাজ সম্পন্ন করা হবে। সারা বিশ্ব সব করে ফেলেছে, বিষয়টি তেমনও না। রাতারাতি তো আর সবকিছু হবে না।’

তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, দুই দফায় বর্তমান সরকারের আমলে নারীর উন্নয়ন হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো, বর্তমান সরকার অংশীদারত্বের জায়গায় হাত দেয়নি। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে ‘যদি’, ‘কিন্তু’ থেকেই গেল। সিডও সনদের সংরক্ষিত ধারা প্রত্যাহার, অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে হাত দিতেই ভয় পেয়েছে সরকার।

রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, নারীবিষয়ক অভিভাবক মন্ত্রণালয় হলেও মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় অনেক ক্ষেত্রেই সরাসরি এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের অংশ নয় বলে তা এড়িয়ে গেছে। নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে এ মন্ত্রণালয় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে, সে ধরনেরও নজির পাওয়া যায়নি। নারীদের চলাফেরা আরও সংকুচিত হয়েছে। তাই উন্নয়ন বা নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও বৈষম্য দূরীকরণ সেভাবে হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সরকার হিসেবে এ সরকারের কাছে প্রত্যাশা বেশি থাকলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রেই হোঁচট খেতে হয়েছে।

নারী উন্নয়নকর্মীরা বলেন, নারী আন্দোলনকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি না মানলেও সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের (স্নাতকোত্তর ডিগ্রি) সমমর্যাদা দিয়ে স্বীকৃতির বিল জাতীয় সংসদে পাস করেছে সরকার। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানিয়ে হেফাজতের আমির এবং কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাক ও আল-হাইয়াতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়ার চেয়ারম্যান শাহ আহমদ শফী বলেছেন, ‘সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো আমাদের সব শর্ত মেনে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি অনুসারে দেশের ওলামায়ে কেরাম ও আমরা দায়িত্বশীলেরা যেভাবে চেয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই স্বীকৃতি পেয়েছি।’ অথচ হেফাজত ২০১৩ সালে তাদের ১৩ দফার মধ্যে ‘প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ করা’সংক্রান্ত দাবি উত্থাপন করেছিল।

তবে নারীর মানবাধিকার রক্ষা বা বৈষম্য দূর করতে সরকার নথিপত্রে অনেক কথা বলেছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়নে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে আগামী ১০ বছরে বিভিন্ন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এর স্বল্পমেয়াদি (দুই বছরে) লক্ষ্যমাত্রায় নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইনে কোনো বৈষম্য থাকলে বা সংশোধনের প্রয়োজন হলে একটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলে। সব ধর্মের বিয়ে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করা, অভিন্ন রেজিস্ট্রেশন ফরম তৈরি করার কথা বলে। মধ্যমেয়াদি (পাঁচ বছরে) লক্ষ্যমাত্রায় উত্তরাধিকার, তালাক ও বিয়ের অধিকার নিশ্চিত করতে আইন প্রণয়ন করা, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, হিন্দু পারিবারিক আইনে সংশোধন করার কথা বলা হয়। উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি ও বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্জিত সম্পত্তিতে নারীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল। তবে একই সঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে (১০ বছর) নীতির এ ধারা ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, তা প্রচারের কথাও বলা হয়। এ কর্মপরিকল্পনায় জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে আইন ও নীতি প্রণয়ন, প্রত্যক্ষ ভোটের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ এসব করা হবে, তার সময় উল্লেখ করা হয়নি।

মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কোনো টাস্কফোর্স গঠন করা হয়নি। মূল কথা, যেসব বিষয়ে ধর্মীয় কোনো কিছু জড়িত, সেসব জায়গায় কোনো হাত দেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীর উন্নয়নে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার ভোটের রাজনীতির কথা চিন্তা করে অনেক বিষয়েই সরকার চুপ ছিল, যা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদেরও কিছু করার ছিল না।