নিজেদের দুর্গেই প্রার্থী নেই বিএনপির!

ভোট রোববার। তবু ভোট নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই ভোটারদের। নেই নির্বাচনী আমেজ-উত্তাপ। এ চিত্র বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মভিটা গাবতলী ও পাশের উপজেলা শাহজাহানপুর নিয়ে গঠিত বগুড়া-৭ আসনের।

আসনটি ‘জিয়া পরিবারের আসন’ হিসেবে পরিচিত। এ আসনে ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব জাতীয় নির্বাচনেই ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। অথচ এবার এ আসনে বিএনপি নেই-ই!

সরেজমিনে শুক্রবার দুটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোটারেরা এবার ভোট দেওয়ার আমেজ না থাকায় হতাশ। গাবতলী উপজেলার বামুনিয়া কামারপাড়ার ভোটার ক্ষীতিশচন্দ্র কর্মকার বলেন, ‘আগে ভোট এলেই প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি আসিচ্চিল। অ্যাকনা ভোটের জন্যি ঘুর ঘুর করিচ্চিল। এবার ক্যাম্বা ভোট চ্যাবার কেউ আসিচ্চেনা। কাক ভোট দিমু, কী ভোট দিমু?’

সোনারায় ইউনিয়নের আটাপাড়া বাজারে কথা হয় আবদুস সামাদের সঙ্গে। ‘কেমন হতে যাচ্ছে এবারের ভোট?’ এমন প্রশ্নের পাল্টা প্রশ্ন করেন তিনি। বলেন, ‘হয়রানি, মামলা, ধরপাকড়—বুঝতে পারছেন? কলাগাছ দাঁড়ালেও এখানে কে পাস করবে, বুঝতে পারছেন? ব্যান্ডেজ করা পা দিয়ে আর কতক্ষণ খেলা যায়? এবার যা বোঝার বুঝে নেন।’
দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ার কারণে প্রথমে বেগম খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা বাতিল হয়। বিকল্প প্রার্থী হিসেবে গাবতলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোরশেদ মিলটন টিকে ছিলেন তখনো। কিন্তু গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ আজম খানের স্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী ফেরদৌস আরা খানের রিটের কারণে হাইকোর্ট বাতিল করে দেন তাঁর প্রার্থিতাও। ফলে আসনটি নিয়ে সাধারণ ভোটারদের আগ্রহ এখন কম।

জাতীয় পার্টির বর্তমান সাংসদ মোহাম্মদ আলতাফ আলী রোববার অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবার লড়ছেন ‘লাঙল’ প্রতীক নিয়ে। আগের বার এই আসনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউই ওইভাবে মাঠে ছিল না। ফলে পাস করতে খুব কষ্ট হয়নি আলতাফ আলীর। সেবার বিএনপির প্রার্থীই ছিল না, আর মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের নীরব সমর্থন ছিল আলতাফ আলীর জন্য আশীর্বাদ।
কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। এবার আওয়ামী লীগ মাঠে নেমেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী ফেরদৌস আরা খানের পক্ষে। তাঁর প্রতীক ডাব। আর হতাশ বিএনপি শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম বাবলুর পক্ষে। তাঁর প্রতীক ট্রাক। শুক্রবার বিএনপি কেন্দ্র থেকে রেজাউল করিমের পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেয়।

রেজাউল করিম জাতীয় পার্টির শাজাহানপুর উপজেলা শাখার তথ্য বিষয়ক সম্পাদক। অন্যদিকে তিনি শেখ রাসেল মোমোরিয়াল সমাজ কল্যাণ সংস্থার শাজাহানপুর উপজেলা কমিটির সহসভাপতি। জাপার দলীয় পদে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শাজাহানপুর উপজেলা জাপার সভাপতি আবদুল হান্নান। তিনি বলেন, ‘ট্রাক মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ব্যক্তি উপজেলা জাপার তথ্য বিষয়ক সম্পাদক। তিনি নিজেকে কখনো রেজাউল করিম আবার কখনো শওকত হোসেন গুলবাগী পরিচয় দিয়ে থাকেন।’
বিএনপির সমর্থনে নির্বাচন করায় জাপা দলীয় কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না, জানতে চাইলে আবদুল হান্নান বলেন, ‘দলের যে কেউ অন্য দলে যেতেই পারেন। এখানে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কিছু নেই।’
উচ্চ আদালতের আদেশে প্রার্থিতা হারানো মোরশেদ মিলটন বলেন, ‘দলের চেয়ারপারসনকে যে ষড়যন্ত্র করে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে, একই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে আমার প্রার্থিতা আটকে দেওয়া হয়েছে। এখন ফাঁকা মাঠে কেউ যাতে গোল দিতে না পারে তাই স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিমের ট্রাক প্রতীককে সমর্থন দিতে দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছে। শুক্রবার বিএনপির কেন্দ্র থেকে সমর্থনের সিদ্ধান্তের বিষয়টি আমাকে জানানো হয়েছে।’

২০১৪ সালের ‘একতরফা’ নির্বাচনেও এই আসনে ছিল উত্তাপ-উত্তেজনা। নির্বাচনের দিন ৮৮ কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ভোট ভন্ডুল করেছিল বিএনপি। তবে এবার প্রার্থিতা হারানোয় দলটির দুর্গখ্যাত এই আসনের নির্বাচনী পরিবেশ অনেকটা নিরুত্তাপ।
গাবতলী পৌরসভার মেয়র ও গাবতলী শহর বিএনপির সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতির সাজানো মামলায় ফরমায়েশি রায়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে তাঁর প্রার্থিতা আটকে দেওয়া হয়েছে।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতার স্ত্রী ফেরদৌস আরা খান স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন না থাকায় প্রথমে রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং পরে ইসি তাঁর মনোনয়ন বাতিল করে। তিনি প্রার্থিতা ফিরে পান কীভাবে?’

এদিকে বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলেরই প্রার্থী রয়েছে। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাংসদ ও দলটির সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল মান্নান এবারও নৌকার প্রার্থী। প্রতীক বরাদ্দের পর তিনি নির্বাচনী মাঠে প্রচারণায় সরব। দুই উপজেলায় গণসংযোগ,পথসভা, কর্মিসভা, উঠান-বৈঠক ছাড়াও লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করে জনগণের কাছে ভোট চেয়েছেন। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নৌকার পোস্টারে ছেয়ে গেছে গোটা নির্বাচনী এলাকা।
কিন্তু উল্টো চিত্র ধানের শীষের প্রার্থী ও বিএনপির সাবেক সাংসদ কাজী রফিকুল ইসলামের প্রচারণার ক্ষেত্রে। প্রতীক বরাদ্দের পর নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণার মাঠে খুব একটা নামতে পারেননি তিনি। নির্বাচনী এলাকায় তেমন দেখা যায়নি ধানের শীষের পোস্টারও। প্রচারণায় নামলেই বাধার মুখে পড়ছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার সোনাতলায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গেলে নৌকার সমর্থকদের বাধার মুখে পড়েন। পরে সংঘর্ষ হয়।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, এই আসনে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মোট ৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহার নামীয় আসামি ৫০০ জন। অজ্ঞাত আসামি আরও কয়েক হাজার।
বিএনপির প্রার্থী কাজী রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বিএনপির গণজোয়ার দেখে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শঙ্কিত। এই কারণে তাঁর প্রচারণায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। পোস্টার টাঙালে ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিএনপির প্রার্থী ভোট ভন্ডুল করার চেষ্টা করছেন। বহিরাগত সন্ত্রাসী ভাড়া করে এনে নৌকার সমর্থকদের ওপর হামলা করে শান্ত মাঠ অশান্ত করছেন। দলীয় কোন্দলেই ধানের শীষের প্রচারণা হচ্ছে না।