'ব্যাটা দুই দিন পরে মর এরাম ভোট আর পাবি?'

খুলনার একটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা গত শুক্রবার বলছিলেন, কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তিনি প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব থেকে রেহাই পেয়েছেন। ভোট নিয়ে তাঁর আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু ভোটকেন্দ্রে ঝামেলা হতে পারে—এই আশঙ্কায় তিনি দায়িত্ব এড়াতে চেয়েছেন। তিনি বললেন, ‘এই নির্বাচনে সরকার জনগণকে ভোট বেটে খাওয়াবে।’ এ কথার অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাংবাদিকেরা সারা দেশের খবর রাখে, আর এই কথার মানে বুঝতে পারছে না, এটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয়।

খুলনা থেকে বিরতিহীন বাস অসংখ্য স্টপেজে থামতে থামতে সন্ধ্যা সাতটায় সাতক্ষীয়া পৌঁছায়। বাস ছিল যাত্রীতে ঠাসা। কিন্তু তিন ঘণ্টার যাত্রাপথে নির্বাচন নিয়ে একটি কথাও কারও মুখে শোনা যায়নি।

সাতক্ষীরাতেও শীত জেঁকে বসেছে। শহরের রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ। রাতে হোটেল থেকে মাইকের আওয়াজ শোনা গেল। ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, স্থানীয় বাসিন্দা নয় এমন কেউ যেন শহরে না থাকে।

এলাকাটির নাম সঙ্গীতার মোড়। সেখান থেকে দূরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়। ফলে রাস্তার পাশে বেশ কিছু চায়ের দোকান। গতকাল শনিবার সকালে যার একটিতে সংসদ নির্বাচনের কিছুটা উত্তাপ পাওয়া গেল। দুই বন্ধু এই উত্তাপ ছড়িয়েছিলেন। পোশাকে–আশাকে নিম্নবিত্ত বলেই মনে হয়। চায়ের দোকানের মালিক ওই বন্ধুদের কাছের মানুষ। আশপাশের দোকানিরাও এই দুই বন্ধুকে চেনেন। কথার ধরনে সে রকমই বোঝা গেল।

‘ধানের শীষে ভোট দিস। আমি ধানের শীষে দেব।’ বিএনপি সমর্থক বন্ধুটি অনেকটা চিৎকার করেই ভোট চাইলেন। ‘কেন রে, আমার মার্কা নেই’ বলেই আওয়ামী লীগ সমর্থক বন্ধু স্লোগান দিলেন, ‘জয় বাংলা।’ আশপাশের কেউ অবশ্য তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন না। একটু দূরেই ছিল পুলিশ। পরিচিতদের একজন বললেন, ‘নৌকা তোরে কী দিছে? খাস তো কামলা খেটে।’ কারও মধ্যে কোনো উত্তেজনা দেখা গেল না। আওয়ামী সমর্থক বন্ধুটি বললেন, ‘বাপের জন্মে পদ্মা বিরিজির কথা কেউ ভাবছিল। সাতক্ষীরার মতো জাগায় মেডিকেল কলেজ। এলাকায় ভিক্ষুকের অভাব নেই।’

ভিক্ষুকের অভাব নেই কথা নিয়ে হাসির রোল পড়ে। অন্তরঙ্গ ঝগড়ায় দু–একটি গালিগালাজ ঢুকে পড়ে।

এমন সময় সাইরেন বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স চলে গেল। বন্ধুদের একজন তখন বলে উঠলেন, ‘ব্যাটা দুই দিন পরে মর। ভোটটা দিয়ে মর। এরাম ভোট আর পাবি?’

দুপুরে কথা হয় শহরের এক চিংড়ি ব্যবসায়ীর সঙ্গে। গণতন্ত্রের বর্তমান খারাপ পরিস্থিতি, পুলিশের হয়রানি, খালেদা জিয়াকে জেলে রাখার পরিণতি নিয়ে অনেক কথাই বললেন। বুঝতে বাকি থাকে না তিনি কোন দলের সমর্থক। বললেন, বিএনপি–জামায়াতের লোকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তারা ভোটকেন্দ্রে যাবেই। তিনি বারবার বললেন, ‘আমি কিন্তু বিএনপি করি না। খালি পরিস্থিতিটা আপনাকে বোঝালাম।’

সাতক্ষীরা সদরে ইভিএমে ভোট হবে। গতকাল এই ব্যবসায়ী বলেছেন, আজ তিনি ভোট দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে যাবেন। ইভিএম নিয়ে তাঁর আগ্রহ আছে, শঙ্কাও।

সাতক্ষীরার উন্নয়নের কথা উঠলেই প্রথমে চলে আসে মেডিকেল কলেজের কথা। ২০১১ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শহরের প্রান্তে মেডিকেল কলেজে যেতে যেতে ভ্যানচালক বললেন, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে তাঁর বাসা, সেখানেই ভোট। এই শহরে ধানের শীষের পোস্টার চোখে পড়ল না কেন জানতে চাইলে ভ্যানচালক বললেন, ‘আছে দুই–চারটা। তলাশ করলি পাবেন।’ নৌকার পোস্টারের মতো বেশি নেই কেন? ভ্যানচালক বলেন, ‘ওদের ত লাগাবার লোক নেই।’

মেডিকেল কলেজটির নির্মাণকাজ চলছে। অনেক অব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। অনেক যন্ত্রপাতির মোড়ক খোলাই হয়নি। মেডিকেল কলেজ থেকে বের হওয়ার সময় এক মহিলার সঙ্গে দেখা, হন্তদন্ত হয়ে কাউকে খুঁজছেন। কী হয়েছে? বললেন, ‘বাবাকে পাচ্ছি না।’ জানালেন, কদিন আগে তাঁর বাবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। সেরে উঠছেন। ভয়ের কিছু নেই। কাল ভোট দেবেন? বললেন, ‘অবশ্যই। তার আগে বুড়ারে ওয়ার্ডে ঢুকাতে হবে।’

এবার ভ্যানে চড়ে শহরে ফেরা। এবারের চালকটি কট্টর আওয়ামী লীগ সমর্থক। বাড়ি আশাশুনি। ওই এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের আ ফ ম রুহুল হক ও বিএনপির শহিদুল আলম লড়াইয়ে নেমেছেন। দুজনই চিকিৎসক। ‘আপনাদের এলাকায় তিন দিন আগে গেছিলাম। শুধু তো রুহুল হকের পোস্টার দেখলাম।’ যুবক ভ্যানচালক বললেন, ‘জামাত–বিএনপি ঘাপটি মেরে আছে। ওদের পোস্টার লাগে না। ভোটের দিন কিলবিল করে বারাবে। প্রশাসন ঠেকাতে পারলি হয়।’