হামলা-সংঘর্ষে নিহত ১৭

কক্সবাজারের পেকুয়ায় মাতবরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সংঘর্ষে নিহত যুবকের মা ও স্বজনদের আহাজারি। গতকাল উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।  ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজারের পেকুয়ায় মাতবরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সংঘর্ষে নিহত যুবকের মা ও স্বজনদের আহাজারি। গতকাল উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ছবি: প্রথম আলো

দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল ভোটের দিন ও আগের দিন রাতে নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৭ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক নয়জন, বিএনপির দুজন, তিনজন সাধারণ মানুষ ও একজন আনসার সদস্য। এর বাইরে নিহত একজনকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই পক্ষই নিজেদের কর্মী বলে দাবি করছে। একজনের পরিচয় জানা যায়নি।

সব মিলিয়ে ১২টি জেলায় সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে আরও অন্তত নয়টি জেলায় সহিংসতায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩০৪ জন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮ জন পুলিশ সদস্য। গতকাল ১০টা পর্যন্ত হতাহতের এ খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচারের শুরুতেই দুজন নিহত হন।

প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর—

চট্টগ্রাম: বাঁশখালীর কাথারিয়া ইউনিয়নের বরইতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবার দিবাগত রাত আড়াইটায় জামায়াত-বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে জাতীয় পার্টি ও পুলিশের সংঘর্ষে আহমদ কবির নামের একজন কৃষক নিহত হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বরইতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রের পাশের একটি মসজিদের মাইকে ভোট ডাকাতি হচ্ছে ঘোষণা দেওয়া হলে জামায়াত-বিএনপির কর্মীরা কেন্দ্রের সামনে জড়ো হয়ে লাঙ্গল প্রতীকের সমর্থক ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় বেশ কয়েকটি গুলি ছোড়া হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহমদ কবির ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত হন পাঁচ পুলিশ সদস্য। পুলিশের দুটি অস্ত্রও খোয়া যায়, যা পরে উদ্ধার হয়েছে।

চট্টগ্রামের পটিয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আবু ছাদেক (১৬) নামের এক মাদ্রাসাছাত্র নিহত হয়েছে। আহত হন তিন পুলিশ সদস্য। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পটিয়ার জিরি এলাকার পশ্চিম মালিয়ারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। উপজেলার কুসুমপুরায় গত শনিবার রাতে খুন হন ইউনিয়নের যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য দীল মোহাম্মদ। পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করলেও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেছেন, তাঁর দলের কেউ জড়িত নন।

কক্সবাজার: পেকুয়া উপজেলার রাজাখালি উলুদিয়া এলাকায় আবদুল্লাহ নামের এক নৌকা–সমর্থক ভোট দিতে গিয়ে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে নিহত হন। গতকাল সকালে মাতবরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের সামনে এ সংঘর্ষে সাতজন আহত হয়েছেন।

রাঙামাটি: গতকাল সকালে কাউখালী উপজেলায় ঘাগড়া ইউনিয়নের রাঙ্গীপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংঘর্ষে ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বাছির উদ্দিন নিহত হন। এ সংঘর্ষে দুই পক্ষের ১৫ জন নেতা-কর্মী আহত হন।

লক্ষ্মীপুর: সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের বড়ালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রের পাশে গুলিতে অজ্ঞাতনামা এক যুবক নিহত হয়েছেন। তাঁর নাম ও রাজনৈতিক পরিচয় জানা যায়নি। শনিবার রাত ১১টার দিকে ডোবা থেকে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে।

কুমিল্লা: চান্দিনা ও নাঙ্গলকোটে নিহত হয়েছেন দুজন। চান্দিনায় পৌরসভার পশ্চিম বেলাশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকের সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট বাক্স ভাঙচুর করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের প্রতিহতের চেষ্টা করলে সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ ১২টি গুলি ছোড়ে। এ সময় মুজিবুর রহমান নামের এক গোডাউন শ্রমিক বুকে গুলি লেগে মারা যান। মুজিবুরের স্ত্রী শাহনাজ বেগম বলেন, তাঁর স্বামী কোনো দল করতেন না, ভোট দিতে গিয়েছিলেন। নাঙ্গলকোট উপজেলার মুরগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সংঘর্ষে হকিস্টিকের আঘাতে মারা যান উপজেলার দৌলখাড় ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপির সহসভাপতি বাচ্চু মিয়া।

ঢাকা-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমেদের ওপর হামলার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। গতকাল সকালে শ্যামপুরে।  প্রথম আলো
ঢাকা-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমেদের ওপর হামলার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। গতকাল সকালে শ্যামপুরে। প্রথম আলো

নোয়াখালী: বেগমগঞ্জের গোপালপুর ইউনিয়নের তুলাচারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ওপর হামলা করতে যাওয়া একদল লোকের গুলি ও লাঠির আঘাতে আনসার সদস্য নুর নবী নিহত হন।

সিলেট: বালাগঞ্জ উপজেলার আজিজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে গতকাল বেলা আড়াইটায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সায়েম আহমেদ সোহেল। তাঁর ভাগনে রায়হান আহমদ বলেন, জাল ভোটের অভিযোগ ওঠার পর সায়েম কেন্দ্রের জানালা দিয়ে উঁকি দিলে ভেতর থেকে গুলি করা হয়। তবে বালাগঞ্জ থানার ওসি গাজী আতাউর রহমান বলেন, এটি কেন্দ্রের বাইরের ঘটনা।

নাটোর: ভোট দেওয়া নিয়ে ভাতিজার ছুরিকাঘাতে চাচা নিহত হয়েছেন। নলডাঙ্গা উপজেলার সমসখলসী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। গ্রামের হোসেন আলী ভাতিজা রতন আলীকে নৌকায় ভোট দিতে বলেন। এ নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে রতন তাঁর কাছে থাকা চাকু দিয়ে চাচার বুকে আঘাত করলে তাঁর মৃত্যু হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া: সদর উপজেলায় রাজঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে বিএনপি–আওয়ামী লীগের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইসরাইল মিয়া নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। তিনি পেশায় রাজমিস্ত্রি। তাঁকে নিজেদের কর্মী দাবি করছে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুপক্ষই।

>নিহতদের মধ্যে নয়জন আওয়ামী লীগের, দুজন বিএনপির, তিনজন সাধারণ ও একজন আনসার সদস্য।

রাজশাহী: জেলার মোহনপুরের পাকুড়িয়া হাইস্কুল কেন্দ্রের সামনে মেরাজ উদ্দিন নামের আওয়ামী লীগের এক কর্মীকে বিএনপির কর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে বিএনপির দাবি, নিহত ব্যক্তি তাদের কর্মী।

রাজশাহী: মোহাম্মদপুর উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে সংঘর্ষের সময় ভোট দিতে গিয়ে বিএনপির কর্মীদের লাঠির আঘাতে মোদাচ্ছের আলী নামের এক আওয়ামী লীগ সমর্থক নিহত হন।

বগুড়া: কাহালুতে একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে সংঘর্ষে আজিজুল নামের একজন নিহত হয়েছেন। তিনি পায়কর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহসভাপতি। বেলা ১১টায় কাহালুর বাগুইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের সামনে এ ঘটনা ঘটে।

গাজীপুর: সিটি করপোরেশনের হারিনাল এলাকায় হারিনাল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের কাছে কুপিয়ে হত্যা করা হয় লিয়াকত হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে। তিনি কাজী আজিমুদ্দীন কলেজের ছাত্রলীগের সাবেক ভিপি।

যশোরে বিএনপির প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলামের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। গতকাল যশোরের বারন্দীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে।  ছবি: প্রথম আলো
যশোরে বিএনপির প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলামের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। গতকাল যশোরের বারন্দীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে। ছবি: প্রথম আলো

নরসিংদী: নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের পর আওয়ামী লীগের প্রার্থীর এজেন্ট মিলন মিয়ার গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। বেলা ১১টায় কুন্দারপাড়া কেন্দ্রে দুই পক্ষের মধ্যে এই সংঘর্ষ হয়।

এ ছাড়া দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ এবং পুলিশের গুলি ও লাঠিপেটায় নোয়াখালীতে ৭০, চাঁদপুরে ৩০, মৌলভীবাজারে ২৪, বরিশালে ১৪, কুমিল্লায় ১৪, ফেনীতে ৩০, রংপুরে ১০, ফরিদপুরে ৮ ও রাজশাহীতে ৪৪ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এর বাইরেও বিভিন্ন জেলায় দু-চারজন করে আহত হয়েছেন।

কুমিল্লা-৮ আসন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে, কুষ্টিয়া সদর আসনে, রংপুরের বদরগঞ্জে, চাঁদপুরের হাইমচরে, হাজীগঞ্জ উপজেলার রামচন্দ্রপুরে, ফরিদপুরের ভাঙ্গায় এবং বরিশালের কয়েকটি স্থানেও দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।