আওয়ামী লীগের দাপুটে জয়

নির্বাচনী প্রচারণায় ছিল আওয়ামী লীগের দাপট। মামলা, হামলা ও পুলিশের ধরপাকড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছিল কোণঠাসা। যার প্রভাব পড়ল নির্বাচনের ফলাফলেও। ভোটের হিসাবে সিলেট জেলার ছয়টি আসনে বড় জয় পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীরা। পাঁচটি আসনে নৌকার প্রার্থীরা একচেটিয়া ভোট পেয়েছেন।

সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর) আসনে নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীকের কোনো প্রার্থী ছিল না। তুলনামূলক অন্য রকম এক পরিবেশে বিজয়ী হয়েছে গণফোরামের প্রতীক উদীয়মান সূর্য প্রতীকে নির্বাচন করা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী মোকাব্বির খান। মহাজোটের মনোনয়নে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করা জাতীয় পার্টির প্রার্থী বর্তমান সাংসদ ইয়াহইয়া চৌধুরী চলে গেছেন চতুর্থ অবস্থানে।

গত রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বেসরকারিভাবে নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় প্রার্থীদের ভোটের পরিসংখ্যানও জানান এই কর্মকর্তা।

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ছয়টি আসনের মধ্যে বিজয়ী ছয়জনের মধ্যে দুজন নতুন প্রার্থী। সিলেট-১ (মহানগর-সদর) আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে আবদুল মোমেন প্রথমবারই ভোটের মাঠে নেমে জয় পেয়েছেন। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মোমেন এই আসনের বর্তমান সাংসদ ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ছোট ভাই। অন্যদিকে সিলেট-২ আসনে বিজয়ী গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোকাব্বির খানও নতুন প্রার্থী। তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। এ আসনে বিএনপিদলীয় প্রার্থী বিএনপির ‘নিখোঁজ’ নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনাকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়ায় মোকাব্বির মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে যুক্তরাজ্যে চলে গিয়েছিলেন। উচ্চ আদালতে তাহসিনার মনোনয়ন বাতিল হলে ভোটের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে দেশে ফিরে ঐক্যফ্রন্টের সমর্থন নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন মোকাব্বির।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এই আসনে মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির সাংসদ ইয়াহইয়া চৌধুরী লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করেন। নৌকার কোনো প্রার্থী না থাকায় সিলেটের অন্যান্য আসনের তুলনায় এখানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছিলেন নির্ভার। নির্বাচনী প্রচারণা ও ভোটের দিন তুলনামূলক ভিন্ন চিত্র ছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন মোকাব্বির।

বিশ্বনাথ ও ওসমানীনগর উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট–২ আসনে মোকাব্বির খান উদীয়মান সূর্য প্রতীকে পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৪২০ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহিবুর রহমান ডাব প্রতীকে পেয়েছেন ৩০ হাজার ৪৪৯ ভোট। সিংহ প্রতীকে ২০ হাজার ৭৪৫ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এনামুল হক সরদার। সাংসদ ইয়াহইয়া চৌধুরী ১৮ হাজার ৩২ ভোট পেয়ে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহিবুর রহমানকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন ইয়াহইয়া চৌধুরী।

এদিকে সিলেট-৫ আসনে গত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া সাংসদ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সেলিম উদ্দিন এবার তৃতীয় হয়েছেন। জেলার দুটি আসনে জাতীয় পার্টির বর্তমান দুই সাংসদই পরাজিত হওয়ায় দলটির এবার সংসদে জেলার প্রতিনিধিত্বকারী কেউ থাকল না। ছয়টি আসনের মধ্যে তিনটি আসনেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীরা তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন। জেলার ছয়টি আসনেই এ দলটি প্রার্থী দিয়েছিল।

রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সিলেট-১ (নগর ও সদর) আসনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের এ কে আবদুল মোমেন (নৌকা)। তিনি পেয়েছেন ২ লাখ ৯৮ হাজার ৬৯৬ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির খন্দকার আবদুল মুক্তাদীর (ধানের শীষ) পেয়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৮৫১ ভোট। তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা রেদওয়ানুল হক চৌধুরী (হাতপাখা)। তিনি পেয়েছেন ২ হাজার ২৪ ভোট।

এ কে আবদুল মোমেন গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখে ভোটাররা আমাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছেন। তাঁদের এ মূল্যায়ন ও ভালোবাসার সম্মান আমি রাখতে চাই। আমার প্রতিটি কাজই হবে এই এলাকার মানুষের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য। এমনকি যেকোনো পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ইতিবাচক পরামর্শও আমি গ্রহণ করব। দলমত–নির্বিশেষে সবার সঠিক পরামর্শে আলোকিত সিলেট গড়াই আমার মূল লক্ষ্য।’

সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) আসনে জয়ী আওয়ামী লীগের মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী পেয়েছেন ১ লাখ ৭৬ হাজার ৫৮৭ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শফি আহমদ চৌধুরী পেয়েছেন ৮৩ হাজার ২৮৮ ভোট। এই আসনে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন খেলাফত মজলিসের মো. দিলওয়ার হোসাইন। তিনি পেয়েছেন ২ হাজার ৯৮৬ ভোট।

সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ) আসনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের ইমরান আহমদ (নৌকা)। তিনি পেয়েছেন ২ লাখ ২৩ হাজার ৬৭২ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির দিলদার হোসেন সেলিম (ধানের শীষ) পেয়েছেন ৯৩ হাজার ৪৪৮ ভোট। এখানে ২ হাজার ৩৭০ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জিল্লুর রহমান (হাতপাখা)।

সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট) আসনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের হাফিজ আহমদ মজুমদার। তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭৩৫ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ঐক্যফ্রন্টের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের উবায়দুল্লাহ ফারুক পেয়েছেন ৮৬ হাজার ১৫১ ভোট।

সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের নুরুল ইসলাম নাহিদ (নৌকা)। তিনি পেয়েছেন ১ লাখ ৯৬ হাজার ১৫ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ফয়সল আহমদ চৌধুরী (ধানের শীষ) পেয়েছেন ১ লাখ ৮ হাজার ৮৯ ভোট। ১০৪২ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের মো. আজমল হোসেন।

রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া সিলেটে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সব দলের প্রার্থীরাও এখানে সহ–অবস্থানে থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ভোটাররাও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কিংবা ভোটারদের কাছ থেকেও সেভাবে কোনো অভিযোগ ছিল না।