গেন্ডারিয়ার শিশু আশামণির সন্দেহভাজন খুনি নাহিদ গ্রেপ্তার

শিশু আশামনির বাবা-মা ও তিন বোন। ঢাকা, ৯ জানুয়ারি। ছবি: আসাদুজ্জামান
শিশু আশামনির বাবা-মা ও তিন বোন। ঢাকা, ৯ জানুয়ারি। ছবি: আসাদুজ্জামান

বড় বোন ইরামণির কোলে চড়ে ঘুরে বেড়াত দুই বছরের ছোট্ট আশামণি। সেদিন (৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় ইরামণি ঘরে ছিল, তার সামনে ঘর থেকে বের হয়ে যায় আশামণি। গ্যাস না থাকায় পাশের বাড়িতে রান্না করতে যান মা রাজিয়া সুলতানা। রান্না শেষে ঘরে ফিরে দেখেন, আশামণি নেই।

আশামণির খোঁজে বাড়ির আশপাশ ঘুরে বেড়াতে থাকে বাড়ির সবাই। তখন পাশের বাড়ির এক ছেলে এসে ইরামণিকে বলে, বাড়ির কাছে চারতলা ভবনের সামনে আশামণি পড়ে আছে। নাকেমুখে রক্ত। মুখে–বুকে আঁচড়ের দাগ। রক্তাক্ত আশামণিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আশামণি যে চারতলা ভবনের নিচে পড়ে ছিল সেই ভবনের মালিক ইকবাল হোসেন। তাঁর ছোট ভাই নাহিদ হোসেন ভবনের তিনতলায় দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়েই থাকেন।

চারতলা ভবনের নিচে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও ওই বাসার কেউ স্বীকার করছিলেন না যে আশামণিকে ওই ভবন থেকে কেউ না কেউ ফেলে দিয়েছে। ছোট্ট আশামণির এমন নৃশংস খুনের খবর পেয়ে এলাকার লোকজন বাড়ি ঘেরাও করলে ভবন মালিকের ছেলেকে আটক করে গেন্ডারিয়া থানার পুলিশ।
আশামণির বাবা ইদ্রিস জানালেন, ভবন মালিকের ছেলে পুলিশকে জানান, তাঁর চাচা নাহিদ এমন ঘটনা ঘটাতে পারে।

শিশু আশা মনি। ছবি: সংগৃহীত
শিশু আশা মনি। ছবি: সংগৃহীত

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গেন্ডারিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হারুন-অর-রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে নাহিদ তিনতলা থেকে পাইপ বেয়ে পাঁচতলায় উঠে যান। এরপর পাঁচতলা থেকে পাশের তিনতলা ভবনে চলে যান তিনি। আবার তিনতলা থেকে পাশের আরেকটি ভবনে চলে যান। পুলিশের হাতে ধরা না দেওয়ার জন্য তিনি ভবন থেকে নিচে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেন। তিন ঘণ্টা চেষ্টার পর নাহিদ শেষ পর্যন্ত তাঁদের হাতে ধরা পড়েন।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের হাতে ধরা না পড়ার জন্য নাহিদ সেদিন যেভাবে এক ভবন থেকে আরেক ভবনে গেছেন, তা বিস্ময়কর। একজন বলেই ফেললেন, ‘স্পাইডার ম্যানের’ মতো নাহিদ সেদিন এক ভবন থেকে আরেক ভবনে গেছেন।’

গেন্ডারিয়ার আশামণি হত্যায় গ্রেপ্তার নাহিদ এখন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গ্রেপ্তার এড়াতে নাহিদ ভবন থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সে বিষয়টি গেন্ডারিয়া থানা-পুলিশ প্রতিবেদন দিয়েই ঢাকার আদালতকে জানিয়েছে।
আদালতকে পুলিশ বলেছে, নাহিদ যে ভবনে থাকেন সেই ভবন থেকে পাশের ভবনের ছাদে লাফ দিয়ে পালানোর সময় হাঁটুর নিচের সম্পূর্ণ অংশে গুরুতর আঘাত পান।

এই ভবনের তিন তলা থেকে আশামনিকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা, ৯ জানুয়ারি।  ছবি: আসাদুজ্জামান
এই ভবনের তিন তলা থেকে আশামনিকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা, ৯ জানুয়ারি। ছবি: আসাদুজ্জামান

নাহিদের ১৪ বছর বয়সী মেয়ে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার আদালতে সাক্ষী হিসেবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা হারুন–অর–রশীদ বলেন, আশামণির খুনের ব্যাপারে নাহিদের মেয়ে আদালতকে বিস্তারিত বলেছে। নাহিদের মেয়ে সেদিন সন্ধ্যায় আশামণিকে তাঁর বাবার কক্ষে দেখতে পায়। আশামণি জোরে চিৎকার করেছিল। নাহিদ সেদিন তিনতলা বাসার ব্যালকনি থেকে নিচে আশামণিকে ফেলে দেন।

আশামণির মা রাজিয়া সুলতানা আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ে আশামণিকে তিনতলা থেকে নাহিদ নিচে ফেলে দেয়। কয়েকজন এই দৃশ্য দেখেছে।’
আশামণিদের বাসা থেকে নাহিদ যে কক্ষে থাকেন, তা দেখা যায়। নাহিদের কক্ষ দেখিয়ে রাজিয়া সুলতানা হু হু করে কেঁদে ওঠেন। তখন তাঁর পাশে ছিল আশামণির নানি নার্গিস বেগম। তিনি বললেন, ‘আমার ছোট্ট সোনামণি আশাকে তিনতলা থেকে ফেলে মেরে ফেলল নাহিদ।’

আশামনির মা রাজিয়া, নানি নার্গিস বেগম। ঢাকা, ৯ জানুয়ারি। ছবি: আসাদুজ্জামান
আশামনির মা রাজিয়া, নানি নার্গিস বেগম। ঢাকা, ৯ জানুয়ারি। ছবি: আসাদুজ্জামান

নার্গিস বেগম বহু বছর ধরে গেন্ডারিয়া এলাকাতে থাকেন। নাহিদকে বহু আগে থেকে চেনেন নার্গিস। তাঁর মেয়ের জামাই আশামণির বাবা ইদ্রিসের জন্মও গেন্ডারিয়ার দ্বীননাথ সেন রোডে।
আশামণিরা গেন্ডারিয়ার অন্য এলাকায় ভাড়া থাকত। চলতি মাসের ৩ জানুয়ারি নাহিদদের পাশের বস্তিতে আসে। এর দুই দিন পর আশামণির মৃত্যু হয়।
নাহিদ আগে ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। প্রথম স্ত্রীর ঘরে এক ছেলে আছে। পরে আবার বিয়ে করেন নাহিদ। এই ঘরে দুই ছেলে, এক মেয়ে। সেই স্ত্রীও বছর পাঁচেক আগে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর থেকে বড় ভাই ইকবালের বাসায় তিনি বসবাস করতেন।

আসামি নাহিদের ভাই ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছোট ভাই নাহিদ তাঁর বাসায় থাকতেন। কয়েক বছর ধরে কোনো কাজ করেন না। বেশির ভাগ সময় বাসায় একাই থাকতেন।

আশামণির হতদরিদ্র বাবা ইদ্রিসের চার মেয়ে। বড় মেয়ে ইরামণির বয়স ৯ বছর। আশামণির বয়স ছিল ২ বছর। সবার ছোট্ট যমজ দুটি মেয়ের (তানজিমা ও ফারিয়া) বয়স ১১ মাস।
আশামণির মৃত্যুর পর তার মা রাজিয়া সুলতানা পাগলপ্রায়। আজ তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর বদলে মৃত্যু চাই। নাহিদের ফাঁসি চাই। আর কিছু চাই না।’