পরাজয়ের কারণ বিএনপিকেই ভেবে দেখতে বললেন প্রধানমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ এই সভার আয়োজন করে। ঢাকা, ১০ জানুয়ারি। ছবি: পিআইডি
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ এই সভার আয়োজন করে। ঢাকা, ১০ জানুয়ারি। ছবি: পিআইডি

নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের কারণ তাদেরকেই ভেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আন্দোলনে যারা ব্যর্থ হয়, তারা নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারে না—এটাই হলো বাস্তবতা।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ এই সভার আয়োজন করে।

২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের কঠোর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারা তাদের অবরোধ ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত কিন্তু আর প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়নি। কারণ জনগণ আর তাদের কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই নেয়নি। জনরোষের কারণে তাদের সব আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।’

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে আটক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের এই দিনেই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁর স্বাধীন স্বদেশ ভূমে ফিরে আসেন। আর এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় পূর্ণতা লাভ করে।

শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে বিএনপির নির্বাচনে ব্যর্থতার কারণ তাদেরকেই অনুসন্ধান করে দেখার আহ্বান জানিয়ে এ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘তারা (বিএনপি) অগ্নিসন্ত্রাস করেছে। ৩ হাজার ৯ শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করেছে। সাড়ে ৩ হাজারের ওপর মানুষকে তারা পুড়িয়েছে। প্রায় ৫০০ মানুষ আগুনে পুড়ে মারা গেছে। ছোট্ট শিশু থেকে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী কেউ বাদ যায়নি। তাদের রুদ্ররোষ থেকে শুধু মানুষ নয়, গাছপালাও রেহাই পায়নি। গাছ কেটেছে, রাস্তা কেটেছে, রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলেছে। এই অপকর্মের পর তারা কীভাবে আশা করতে পারে জনগণ আবার তাদের ভোট দেবে।’

এ সময় অর্থ আত্মসাৎ মামলায় খালেদা জিয়ার কারাগারে আটক থাকার পাশাপাশি একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক রহমানকে দলের চেয়ারপারসন করায় নেতৃত্বের শূন্যতা, বিএনপির নির্বাচনে পরাজয়ের একটি প্রধানতম কারণ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘তাদের দলে কি এমন কোনো ভালো মানুষ নেই, যাকে তারা চেয়ারপারসন বানাতে পারে, তারা বানালো একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে।’

দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে বিএনপির বিরুদ্ধে মনোনয়ন–বাণিজ্যের অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, উপযুক্ত প্রার্থীকে মনোনয়ন না দিয়ে কেবল অর্থের বিনিময়ে অনেক অখ্যাত, স্বল্প পরিচিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়ায় দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে।
কেবল যোগ্য প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় বিএনপি যেসব আসন হারিয়েছে, তার গুটিকয়েক উদাহরণ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ধামরাইয়ে আতাউর রহমান খানের ছেলে জিয়াউর রহমান, আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, তিনি মনোনয়ন পেলে তো জিতবেনই। কিন্তু তাঁকে না দিয়ে যে বেশি টাকা দিল, তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হলো। নারায়ণগঞ্জে তৈমুর আলম খন্দকারকে মনোনয়ন দেওয়া হলো না, চট্টগ্রামে মোর্শেদ খানকে না দিয়ে যে ভালো টাকা দিল, তাঁকেই মনোনয়ন দিল।’ এই মনোনয়নবঞ্চিত ব্যক্তদের অনেকে তাঁর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে দেখা করে এসব কথা জানিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এসবের সঙ্গে বিদেশে অবস্থানরত তারেক রহমানের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ভাইয়াকে আবার পাউন্ডে সেখানে পেমেন্ট করতে হবে।’

শেখ হাসিনা এ সময় স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত–শিবিরকে মনোনয়ন দেওয়ায় বিএনপির ভরাডুবির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘যেখানে উচ্চ আদালত থেকে একটি দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী; সেই জামায়াতের ২৫ জন মনোনয়ন পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। তারা যুদ্ধাপরাধীকে কখনই ভোট দেবে না। ভোট তারা দিতে চায়ও না। ভোটও দেয়নি।’ ‘যাদের কোনো রাজনীতিই নেই; কেবল দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মানি লন্ডারিং, এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করা, অগ্নিসন্ত্রাস এবং মানুষ হত্যা যাদের নীতি, তারা জেতার আশা কীভাবে করে?’ প্রশ্ন তোলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

বাংলাদেশের উন্নয়নের সুফলটা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারাতেই ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় হয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যে কারণে বাংলাদেশের জনগণ আজকে ভোট দিয়ে আমাদের নির্বাচিত করেছে, যার ফলে আমরা আবার দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পাচ্ছি।’

আওয়ামী লীগ সভাপতি এ সময় নৌকা এবং মহাজোটের প্রার্থীদের বিজয়ী করায় সব শ্রেণি-পেশার জনগণ তথা সমগ্র দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘সাধারণ মানুষ শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, উন্নয়ন চায়, নিজের জীবনের উন্নতি চায়—সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই তারা আমাদের ভোট দিয়ে সেবা করার সুযোগ দিয়েছে।’

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই স্বাধীনতা পূর্ণতা লাভ করে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁরা জানতে পারেননি বঙ্গবন্ধু কি বেঁচে আছেন, না নেই। অথচ পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে না গিয়ে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণের মাধ্যমে জাতিকে যে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন, সে অনুযায়ীই আওয়ামী লীগ সরকার পরিচালনা করছে। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
বাঙালির জীবনে ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনা না ঘটলে বাংলাদেশ আরও অনেক আগেই উন্নত সমৃদ্ধ হতে পারত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাঁচাত্তর–পরবর্তী শাসকেরা বাংলাদেশের অস্তিত্বেই বিশ্বাসী ছিল না, যে কারণে দেশের কোনো উন্নয়ন হয়নি। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই জনগণ প্রথম উন্নয়নের ছোঁয়া লাভ করে। তিনি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘জনগণ ভোট দিয়ে আমাদের ওপর যে আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে, সেই বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলব ইনশা আল্লাহ। সেই বিশ্বাস আমাদের আছে।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটি পড়ার জন্য দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি এ সময় ‘সিক্রেটস ডকুমেন্টস অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রতিবেদন নিয়ে প্রকাশিত এবং প্রকাশিতব্য মোট ১৪ খণ্ড ভলিউমের বই থেকে আরও তথ্য জানতে পারবেন বলেও উল্লেখ করেন।