এক মাস পার হলেও ধরা পড়েনি নূর খাতুনের খুনি

আজও রক্তের দাগ লেগে আছে শাটারে। কেরানীগঞ্জ, ১০ জানুয়ারি। ছবি: আসাদুজ্জামান
আজও রক্তের দাগ লেগে আছে শাটারে। কেরানীগঞ্জ, ১০ জানুয়ারি। ছবি: আসাদুজ্জামান

ভবনটি সাততলা। তিনতলা পর্যন্ত পোশাক বিক্রির দোকান। চারতলার একটি অংশে মসজিদ ছাড়া বাকি সব তলায় পোশাক কারখানা। ভবনের নিচে আন্ডারগ্রাউন্ডের দোকানগুলোয় রাখা হয় পোশাক সংশ্লিষ্ট সামগ্রী। এই ভবনে প্রবেশ করার পথ আছে একটা। ছুটির দিনে প্রধান ফটকসহ আন্ডারগ্রাউন্ডে ঢোকার ফটক পুরোপুরি বন্ধ রাখা হয়।

৭ ডিসেম্বর ঢাকার কেরানীগঞ্জের আগা নগরে এই সাততলা ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে নূর খাতুন নামের এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। নূর খাতুন ওই ভবনের কয়েকজন শ্রমিকের কাছে টাকার বিনিময়ে ভাত খাওয়াতেন।

নূর খাতুনের স্বামী ভাই ওসমান গনি ও তাঁর ভাই ওসমান গণির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৭ ডিসেম্বর তাঁরা নূর খাতুনের সন্ধান না পেয়ে সন্ধ্যার দিকে পূর্ব আগা নগরের সাততলা ভবনে (মাকসুদা গার্ডেন সিটি) যান। তখন ভবনের সাততলায় থাকা একটি পোশাক কারখানার কর্মচারীরা তাঁদের জানিয়ে দেন, নূর খাতুন দুপুরে ভাত দিয়েই চলে গেছেন। এরপর কবির ও তাঁর স্বজনেরা আশপাশের পোশাক কারখানায়ও নূর খাতুনের ছবি দেখিয়ে খোঁজ করে চলেন।

কবির হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাত তখন ৮টা বাজে। আবার সাততলা ভবনের সামনে এসে তিনি জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, নূর খাতুনকে কেউ দেখেছেন কি না। তখন অজ্ঞাত কয়েকজন যুবক জানান, ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে এক নারী শুয়ে আছেন। তখন তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডের পশ্চিম পাশের ফ্লোরে গিয়ে দেখেন স্ত্রী নূর খাতুনের ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে আছে।

কবির হোসেন ও নূর খাতুন ছবি: সংগৃহীত
কবির হোসেন ও নূর খাতুন ছবি: সংগৃহীত

এদিকে লাশ উদ্ধার হওয়ার পরদিন ৮ ডিসেম্বর নূর খাতুনের ভাই ওসমান গনি দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। প্রথমে মামলাটি তদন্তভার পরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মহিদুল ইসলামের ওপর। মহিদুল বৃহস্পতিবার (১০ জানুয়ারি) প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ধারণা নূর খাতুনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এক সপ্তাহ তিনি এই মামলার তদন্ত করেছিলেন। পরে তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পাঠানো হয়।

মামলাটি এখন তদন্ত করছেন পিবিআইয়ের এসআই সাইদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সদ্য কেস ডকেট (মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র) হাতে পেয়েছেন তিনি। যত দ্রুত সম্ভব তিনি এই খুনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করবেন।

বৃহস্পতিবার (১০ জানুয়ারি) সরেজমিনে দেখা যায়, যে দোকানের সামনে নূর খাতুনের লাশ পড়ে ছিল, সেই দোকানের শাটার বন্ধ। তাতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ স্পষ্ট। ওই ভবনের সাততলায় আছে একটি গার্মেন্টস কারখানা। এই কারখানার ৮ জন শ্রমিককে ছয় মাস ধরে টাকার বিনিময়ে ভাত খাওয়াতেন নিহত নূর খাতুন। এই ৮ জনের বয়স ১৫ থেকে ২০–এর মধ্যে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে কারখানায় গিয়ে ওই ৮ জনের কাউকে পাওয়া যায়নি। কারখানার কর্মী তানজিল হোসেন বলেন, নির্বাচনের আগে ছুটি পেয়ে সবাই যাঁর যাঁর বাড়িতে গেছেন। দু-এক দিনের মধ্যে সবাই কারখানার কাজে যোগ দেবেন।

নূর খাতুনের কাছে ভাত কিনে খেতেন হৃদয় নামের এক যুবক। মুঠোফোনে হৃদয় প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন দুপুরে ভাত দিয়ে চলে যান নূর খাতুন। এরপর রাতে খবর পান, ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে তাঁর লাশ পড়ে আছে। এর বেশি কিছু তিনি জানেন না। হৃদয় বলেন, ঘটনার দিন তাঁদের কাছ থেকে সপ্তাহ খাওয়ার পাওনা টাকা নিয়েছিলেন নূর খাতুন।

ভবনের ব্যবস্থাপক ফারুক যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে পড়ে ছিল নূর খাতুনের ভাতের দুটি বাটি। কেরানীগঞ্জ, ১০ জানুয়ারি। ছবি: আসাদুজ্জামান
ভবনের ব্যবস্থাপক ফারুক যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে পড়ে ছিল নূর খাতুনের ভাতের দুটি বাটি। কেরানীগঞ্জ, ১০ জানুয়ারি। ছবি: আসাদুজ্জামান

ভবনের নিরাপত্তারক্ষী ষাটোর্ধ্ব মজিবুর রহমান বলেন, নূর খাতুনকে কে বা কারা আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে হত্যা করেছে, তা তিনি জানেন না। সেদিন কোনো কিছু টেরও পাননি।

ডান পাশের যে সিঁড়ির গোড়ায় নূর খাতুনের ভাতের বাটি পাওয়া যায়, সেই জায়গাটি বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই সিঁড়ি ছাড়াও ভবনে ওঠার আরও দুটি সিঁড়ি আছে। প্রতিটি সিঁড়ি ব্যবহার করে ভবনটির সব তলায় চলাচল করা যায়। সেখানে কোনো ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা দেখা যায়নি। ভবনের ব্যবস্থাপক মো. ফারুক বলেন, ডান পাশের সিঁড়িতে নূর খাতুনের ভাতের বাটি পাওয়ায় নিশ্চিত যে নূর খাতুনকে ডান পাশের সিঁড়ি দিয়ে নামানো হয়েছে বা তিনি নেমেছিলেন। কারণ আন্ডারগ্রাউন্ডের প্রধান ফটক বন্ধ ছিল।

নূর খাতুনের তিন মেয়ে—রেহানা (১১), ফাহিমা (৭) ও ফাউজিয়া (৫) কেরানীগঞ্জে লেখাপড়া করত। সবার ছোট—ছেলে ইব্রাহীম, বয়স আড়াই বছর।

সেলুনের দোকানে কাজ করা নূর খাতুনের স্বামী কবির বলেন, বাড়িভাড়া দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ জন্য নূর খাতুন কয়েক মাস আগে ভাত বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। নূর খাতুন হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা ছেড়ে শরীয়তপুরে গ্রামের বাড়িতেই থাকছেন কবির।