ছেলে বাঁচবে, সেই আশাতেই তাঁরা

মা–বাবার সঙ্গে ফারহাতুল মাহমুদ হাসান। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
মা–বাবার সঙ্গে ফারহাতুল মাহমুদ হাসান। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ফারহাতুল মাহমুদ হাসানের বয়স মাত্র ৯ বছর ৩ মাস। এই বয়সেই তাঁর শরীরে আস্তানা গেড়েছে ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া। শুধু তা–ই নয়, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ও ব্লাড ক্যানসার। তিনটি জটিল রোগের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে ফারহাতুলকে সব সময় সংগ্রাম করতে হচ্ছে। একটিকে একটু দুর্বল করে তো আরেকটি আবার সবল হয়ে শরীরে ফিরে আসে। সব মিলিয়ে ফারহাতুল এখন ক্লান্ত।

আর ফারহাতুলের বাবা সাদেকুল ইসলাম এবং মা শিউলি আক্তার ছেলেকে একটু ভালো রাখতে চেষ্টার কোনো কমতি করছেন না। ছেলের চিকিৎসার জন্য টাকার সংস্থান করতে গিয়ে রংপুরের জমি বিক্রি করেছেন। সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক-সংস্থা, বন্ধু-আত্মীয় সবার সহযোগিতায় এ পর্যন্ত ছেলের চিকিৎসা চালিয়ে এসেছেন। কিন্তু সামনে যেতে হবে আরও অনেক পথ। তাই ছেলের জীবন বাঁচাতে দেশের জনগণের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়েছেন এ বাবা-মা।

সাদেকুল ইসলাম ব্যবসা করেন। ছেলেকে নিয়ে দেশ-বিদেশের হাসপাতালেই তাঁকে কাটাতে হয় অনেকটা সময়। বর্তমানে প্রতিদিন ছেলের জন্য লাগে প্রায় ছয় হাজার টাকার ওষুধ। ফারহাতুলের যখন চার বছর বয়স, তখন থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। এরপর আস্তে আস্তে অন্য দুটো ধরা পড়ে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ফারহাতুলের পেছনে খরচ হয়ে গেছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। ছেলেকে নিয়ে এ পর্যন্ত চেন্নাই গিয়েছেন পাঁচবার। আর বাংলাদেশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে কত হাসপাতাল যে ঘুরেছেন, এর কোনো হিসাব নেই। যখন যে হাসপাতালে গেছেন, সেখানকার চিকিৎসকদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র, সুপারিশ, রিপোর্ট—সব যত্ন করে রেখে দিয়েছেন সাদেকুল।

সবকিছু ঠিক থাকলে ১৫ জানুয়ারি ছেলেকে নিয়ে আবার ছুটবেন ভারতের চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো ক্যানসার হাসপাতালে। পরীক্ষায় সবকিছু ঠিক থাকলে সেখানেই হবে ছেলের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন। এ ক্ষেত্রে বাবা নিজেই দাতা হওয়ায় খরচ কিছুটা কমবে। এরপরও চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে বাংলাদেশি প্রায় ৪০ লাখ টাকা লাগবে।

ফারহাতুলের বাবা সাদেকুল বললেন, ‘ছেলের জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে সহায়তার যে টাকা পেয়েছি, তাতে করে আমাদের কাছে ২০ লাখ টাকা জমা আছে। জনগণের কাছে বেশি চেয়ে লাভ নেই, এই মুহূর্তে যদি ২০ লাখ টাকা সহায়তা পাওয়া যায়, হয়তো ছেলের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে পারব।’

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনশ্রীতে সাদেকুল দম্পতির বাসায় গেলে ফারহাতুল নিজেই দরজা খুলে দেয়। এরপরই নিজের ঘরে চলে যায়। মা-বাবার সঙ্গে একটি ছবি তুলতে বললে প্রথমে কিছুতেই রাজি হয় না ফারহাতুল। পরে গোমড়া মুখে ছবি তুলতে বসে। এক ফাঁকে ফারহাতুলের মুখে হাসির ঝিলিক দেখে মা-বাবার মুখেও হাসির রেখা দেখা দেয়। কিন্তু ফারহাতুলের হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না; বরং চোখ ছলছল করতে থাকে।

ছেলে নিজের রুমে চলে যাওয়ার পর সাদেকুল জানালেন, ফারহাতুল আগে তেমন কিছু বুঝতে পারত না। তবে এখন নিজেই ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে তার রোগগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। ইংরেজিতে খুব ভালো হওয়ায় রোগগুলো সম্পর্কে ইন্টারনেটে যে কথাগুলো লেখা আছে, এর অর্থও বুঝতে পারে। ফলে দিন দিন নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীরা বাসায় এলে সে খুব বিরক্ত হয়। অসহায় বোধ করে। কেননা, বুঝতে পারে, তাকে নিয়ে কথা বলার জন্যই গণমাধ্যমকর্মীরা এসেছেন।

ফারহাতুলকে মাসে তিন ব্যাগ রক্ত ( রেড সেল) দিতে হয়। শরীর একটু বেশি খারাপ হলে ওর পা ব্যথা করে। গিঁঠে গিঁঠে ব্যথা হয়। খিঁচুনি হয়। বমি করে। খেতে পারে না।

ফারহাতুলের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া বন্ধ অনেক দিন আগে থেকে। তবে ছেলে যাতে মন খারাপ না করে, তাই মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী শাখায় স্কুলের হাজিরা খাতায় তার নাম আছে। স্কুলের শিক্ষকেরা প্রতিবছর তাকে প্রমোশন দিয়ে দেন। সেই হিসাবে ফারহাতুল বর্তমানে চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্কুল কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত ফারহাতুলের চিকিৎসা সহায়তায় অনেকবারই এগিয়ে এসেছে।

ফারহাতুলের থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ার পর সাদেকুল ও তাঁর স্ত্রী প্রথম জানতে পারেন, তাঁরা দুজন এ রোগের বাহক। তাঁদের তিন বছর বয়সী আরেক ছেলে এখন পর্যন্ত সুস্থ আছে।

ফারহাতুল কিছুদিন আগেও বড় হয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইত। এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে জানতে চাইলে চুপ করে থাকে। সে হয়তো বুঝে গেছে এই ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণের জন্য অনেকগুলো পাহাড়সম ধাপ পার হতে হবে। তাই ছোট মুখটিতে নেমে আসে অন্ধকারের ছায়া। ফারহাতুলের দিন কাটে ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে কম্পিউটারে গেমস খেলে।

ফারহাতুলের চিকিৎসায় কেউ সহায়তা করতে চাইলে:
মো. সাদেকুল ইসলাম, সঞ্চয়ী হিসাব-১২৫১১, ইসলামী ব্যাংক, রামপুরা শাখা অথবা সঞ্চয়ী হিসাব-১৯২২১০৭০০১০৪৪০, প্রাইম ব্যাংক, বনশ্রী শাখায় পাঠাতে পারেন। এ ছাড়া ০১৮৬৪২৯১৩২৭ অথবা ০১৮৬৪২৯১৩২৮ বিকাশ নম্বরেও পাঠানো যাবে।