আবার সরকারি কর্মকর্তা গ্রেপ্তার দুদকের 'টেস্ট কেস'!

সরকারি চাকরি আইনে কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা যাবে কি যাবে না, সেই বিতর্কের মধ্যেও মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে অভিযান চালিয়ে ৬ লাখ টাকাসহ একজন রাজস্ব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত বছরের অক্টোবরে জাতীয় সংসদে পাস হয় সরকারি কর্মচারী আইন, ২০১৮। ওই আইনে বলা হয়েছে, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধ করলেও আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করতে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।

১০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা (প্রশাসন) নাজিম উদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তার করে দুদক। অভিযানের সময় কাস্টম হাউসের নিচতলায় তাঁর কক্ষের স্টিলের আলমারি খুলে ৬ লাখ টাকা উদ্ধার করেন দুদকের কর্মকর্তারা। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে এই টাকা জব্দ করা হয়। সমুদ্রগামী জাহাজের ছাড়পত্র দিতে ঘুষ–বাণিজ্যের বিষয়ে দুদকের অভিযোগ কেন্দ্রে (হটলাইন ১০৬) অভিযোগ দেন ভুক্তভোগী জাহাজ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। এরপরই দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের সদস্যরা সেখানে অভিযান চালান।

দুদকের উচ্চপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারি কর্মচারী আইন পাস হওয়ার পর দুদক অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। নতুন এই অভিযানের মাধ্যমে তারা প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছে। এটাকে একটা ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে দেখছে তারা।

সূত্র জানায়, অক্টোবরে সরকারি কর্মচারী আইন পাস হওয়ার পর থেকে দুদক কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করেনি। অবশ্য আইনটি পাস হওয়ার পর দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ একাধিকবার গণমাধ্যমে বলেছেন, দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ কোনো প্রভাব ফেলবে না। দুদকের ফাঁদ মামলা ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান আগের মতোই চলবে।

তবে দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান এটাকে টেস্ট কেস বলতে নারাজ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘দুদক তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা কোনো সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করিনি। একজন দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীকে গ্রেপ্তার করেছি।’

১৯৬৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী, দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত পর্যায়েও যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ৫ ধারায়ও এ বিধান বলবৎ রাখা হয়েছে। সরকারি কর্মচারী আইনে প্রস্তাব রয়েছে, এই বিধান তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।

আইনটির এ ধারার উপধারা (১)-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। যদি গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হয়, তবে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে।’

গত বছর নতুন আইনটি নিয়ে যখন তোড়জোড় চলছিল, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছিলেন, গত তিন বছরে দুদকের হাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের হার অনেক বেড়েছে। তা থেকে নিস্তার পেতে দুদকের গ্রেপ্তারের ক্ষমতা কমাতে চেয়েছেন তাঁরা।

তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ৩৮৮ জনের মধ্যে ১৬৮ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হওয়া ১৮২ জনের মধ্যে ৮৪ জন সরকারি কর্মকর্তা। গত বছর দুদকের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৫ জনের বেশি সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারী। এর বাইরে মামলা হয়েছে দ্বিগুণের বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে।

গত দুই বছরে দুদক পরিচালিত ২৯টি ফাঁদে ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৯ জন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁদের বেশির ভাগই সেবা খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা। সাম্প্রতিক সময়ে নৌ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী নাজমুল হককে ঘুষের ৫ লাখ টাকাসহ রাজধানীর একটি হোটেল থেকে গ্রেপ্তার করে দুদক। আগের বছর একই দপ্তরের আরেক প্রধান প্রকৌশলী নিজ দপ্তরেই গ্রেপ্তার হন ঘুষের টাকাসহ।

দুদক সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারের তালিকায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা–কর্মচারীও রয়েছেন। সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের এ তালিকায় নেওয়া হলে গ্রেপ্তারের সংখ্যা আরও বড় হবে।

এই আইন নিয়ে নাগরিক সমাজ ও আইনজীবীদের মধ্যেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তাঁরা বলছেন, দেশের ১৬ কোটি মানুষকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করতে কারও অনুমতি না লাগলেও মাত্র ১২ লাখ সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করতে অনুমোদন লাগবে। তাঁদের মতে, এর মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়েছে। আইনের চোখে সবাই সমান। তাই গ্রেপ্তার ও শাস্তির ক্ষেত্রে সবার জন্য একই বিধান থাকবে—এটাই সংবিধানের কথা।