২৩৯ বছর ধরে মারবেল মেলা!

বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে ‘২৩৯’ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে মার্বেল মেলা। এতে অংশ নেন আশপাশের কয়েকটি উপজেলার মানুষ। ১৫ জানুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে ‘২৩৯’ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে মার্বেল মেলা। এতে অংশ নেন আশপাশের কয়েকটি উপজেলার মানুষ। ১৫ জানুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো

এক-দুই যুগ নয়, একটি মেলা চলে আসছে দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে! অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমনটাই বলছে আয়োজক পক্ষ। ঐতিহ্যবাহী এই মেলার নাম মার্বেল মেলা। এটি বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রামানন্দের আঁক গ্রামে পৌষসংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। মঙ্গলবার (১৫ জানুয়ারি) ছিল এই মেলার ২৩৯তম আয়োজন।

আয়োজক পক্ষ বলছে, ১৭৮০ সাল থেকে এই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাঁদের ‘মা সোনাই চাঁদ আউলিয়ার’ স্মরণে এই মেলার আয়োজন করছে। বরিশালের আগৈলঝাড়া, গৌরনদী, উজিরপুর, বানারীপাড়া, বাকেরগঞ্জ ও গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া, মাদারীপুরের ডাসার কালকিনিসহ পার্শ্ববর্তী জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন বয়সের হাজার-হাজার নারী-পুরুষ এই দিনে মার্বেল খেলায় অংশ নেন।

এ মেলা বাস্তবায়নের জন্য ৩৫ সদস্যের একটি মেলা উদ্‌যাপন কমিটি রয়েছে। মারবেল মেলা আয়োজন কমিটির সভাপতি দ্বিগবিজয় বিশ্বাস বলেন, ‘১৭৭৯ সালে রামানন্দের আঁক গ্রামে ৬ বছর বয়সী আউলিয়া মা সোনাই চাঁদের বিয়ে হয় একই গ্রামের এক কিশোর ঠাকুরের সঙ্গে। বিয়ের এক বছর পরে স্বামী কিশোর ঠাকুর মারা গেলে নিঃসন্তান অবস্থায় শ্বশুরবাড়িতে থাকেন সোনাই চাঁদ। তিনি একটি নিমগাছের গোড়ায় শিবের আরাধনা ও পূজা-অর্চনা আরম্ভ করেন। ক্রমশ তাঁর অলৌকিকত্ব ছড়িয়ে পরলে ওই স্থানে বাৎসরিক পূজার আয়োজন করা হয়। তাঁর জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৭৮০ সাল থেকে প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির দিনে নবান্নের আয়োজনের মাধ্যমে মার্বেল মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তাঁর মৃত্যুর পর ওই বাড়িটি সোনাই আউলিয়ার বাড়ি হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করে।’

মার্বেল মেলায় সব বয়সী মানুষ অংশ নিয়ে থাকেন। আগৈলঝাড়া, বরিশাল, ১৫ জানুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো
মার্বেল মেলায় সব বয়সী মানুষ অংশ নিয়ে থাকেন। আগৈলঝাড়া, বরিশাল, ১৫ জানুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো

মেলা উদ্‌যাপন কমিটি সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর এই দিনটি উপলক্ষে বৈষ্ণব সেবা, নামসংকীর্তন, কবিগান শেষে সোয়া মণ চালের গুঁড়ার সঙ্গে সোয়া মণ আখের গুড়, ৫০ জোড়া নারকেল ও প্রয়োজনীয় কলাসহ অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে নবান্ন তৈরি করে মেলায় আসা দর্শনার্থীদের প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়।

মার্বেল মেলার মার্বেল খেলা সম্পর্কে স্থানীয় প্রবীণ হরেন বিশ্বাস (৮২) বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা এ খেলার মাধ্যমে মেলার প্রচলন করেছিলেন, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। তাঁদের উত্তরসূরি হিসেবে আমরা সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। এদিনটিকে ঘিরে রামানন্দের আঁক গ্রামে মহোৎসবের আমেজ থাকে। গ্রামের লোকজন তাঁদের মেয়ে-জামাইসহ অন্য আত্মীয়স্বজনের এ মার্বেল মেলায় আমন্ত্রণ জানান এবং মেলা উপলক্ষে স্বজনেরা একত্র হন।’

মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা গেছে, রামানন্দের আঁক গ্রামের প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মার্বেল খেলা চলছে। রাস্তার ওপর, বাড়ির আঙিনা, অনাবাদি জমি, বাগানসহ সর্বত্রই মার্বেল খেলার আসর বসেছে। জমিতে বসেছে বাঁশ-বেত শিল্পসামগ্রী, মনিহারি, খেলনা, মিষ্টি, ফলসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান। মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা।

কোটালীপাড়া উপজেলা থেকে মেলায় আসা সমীর মণ্ডল (৩৭) জানান, এই এলাকার ঐতিহ্যবাহী মার্বেল খেলায় প্রতিবছর স্বজনদের নিয়ে যোগদান করে আনন্দ উপভোগ করেন। বাসাইল গ্রামের নবম শ্রেণির ছাত্র অনুপম দাস ও ১০ম শ্রেণির প্রদীপ রায় জানায়, এ মেলায় মার্বেল খেলার জন্য সারা বছর তারা টিফিনের টাকা থেকে কিছু টাকা জমিয়ে রাখে।

আগৈলঝাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম আফজাল হোসেন বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মেলা শেষ করতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।