সবাই খুঁজছে বাড়ির চাবি

বাংলামোটরে বাসা থেকে বড় ছেলেসহ পিতা নুরুজ্জামান কাজলকে বের করে নিয়ে আসেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।  ৬ ডিসেম্বর দুপুরে। ছবি: প্রথম আলো
বাংলামোটরে বাসা থেকে বড় ছেলেসহ পিতা নুরুজ্জামান কাজলকে বের করে নিয়ে আসেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। ৬ ডিসেম্বর দুপুরে। ছবি: প্রথম আলো
>

• ৫ ডিসেম্বর বাংলামোটরে শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার
• শিশুর বাবা নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে মায়ের মামলা
• বাবা শিশুকে হত্যা করেছেন, এমন তথ্য মেলেনি
• বাংলামোটরে নুরুজ্জামান কাজলদের প্রচুর সম্পত্তি
• নুরুজ্জামান এখন কারাগারে, বাড়ির ফটকে তালা

রাজধানীর বাংলামোটরে একটি দোতলা বাসায় শিশুসন্তানকে খুন করে চাপাতি হাতে ঘুরছেন বাবা—গত ৫ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা নিউজ পোর্টালগুলো থেকে এমন খবরই পাচ্ছিলেন সবাই। ছয় ঘণ্টার পুলিশি অভিযান শেষে বাবা নুরুজ্জামান কাজল এক সন্তান কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। আর তাঁর মৃত শিশুটি নিয়ে বেরিয়ে আসেন মসজিদের ইমাম। পুলিশ আলামত সংগ্রহ করে ফটকে তালা দিয়ে চলে যায়।

শিশু নূর সাফায়েতের মৃত্যু আসলে কী করে হলো, কী বলছেন তাঁর আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী বা পুলিশ? সাফায়েতের অন্য ভাইটিই-বা কোথায়? এই খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল, সবার আগ্রহ ফটকের চাবি নিয়ে। সাফায়েতের মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনও এই একটা জিনিসই খুঁজছেন। চাবি চান নুরুজ্জামান কাজলদের যৌথ মালিকানাধীন জমির ওপর ওঠা মার্কেটের দোকানি ও গুদামঘরের ভাড়াটেরাও।

হত্যা মামলার আসামি নুরুজ্জামান কাজল এখন কারাগারে। তিনি ভবনটি কবজায় রাখতে সব অংশীদারকে বের করে দিয়ে চাপাতি হাতে ঘুরে বেড়াতেন। এখন সে বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে। ভবনটির ফটকে তালা। গত শনিবার সেখানে গেলে বাড়ির ভেতর থেকে দুর্গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দেয়।

নুরুজ্জামান কাজলের বাবা মনু মেম্বার বাংলামোটরে বেশ প্রভাবশালী লোক ছিলেন। ছেলেমেয়েদের দাবি, এলাকার যে একমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি, সেটিও তাঁদের জমির ওপর। বাংলামোটরের যে ভবনটি থেকে নুরুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়, সেটি ছাড়াও ওই এলাকায় তাঁদের কমপক্ষে ১০টি দোকান ও বেশ কয়েকটি গুদামঘর আছে। নুরুজ্জামান, তাঁর তিন ভাই ও মৃত এক ভাইয়ের ছেলে—সবাই এক ভবনে থাকতেন। দোকানপাট আর গুদামঘরের ভাড়া তুলে সবাই ভাগ করে নিতেন। এটাই তাঁদের আয়ের উৎস। নূর সাফায়েতের মৃত্যুর পর তার মা মালিহা প্রিয়া স্বামী নুরুজ্জামান কাজলের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। পুলিশ জানায়, নুরুজ্জামান জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, তাঁর ভাই-ভাইপোরা জায়গাজমি দখল করে নেবেন। এ কারণেই তিনি একে একে সবাইকে বের করে দেন। সব শেষে বাড়ি থেকে তাড়ান স্ত্রী মালিহা প্রিয়াকে। নুরুজ্জামান কাজল গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী আবার বাড়িতে উঠতে চাইছেন। বাড়িতে উঠতে চাইছেন নুরুজ্জামানের ভাইয়েরাও। কিন্তু চাবি পাচ্ছেন না।

মামলার বাদী মালিহা প্রিয়ার সঙ্গে গত শনিবার কথা বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়েছে। তাঁর বাবা ফোন ধরে বলেন, মেয়ে নাতিসহ তাঁর কাছে আছেন। নিয়মিত শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন। তবে চাবিটা পাচ্ছেন না। বাসায় ঢুকতে পারছেন না।

নুরুজ্জামান কাজলের ভাই নুরুল হুদা উজ্জ্বল ভাইপোর মৃত্যুর খবর শুনে সবার আগে বাসায় ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁকেও নুরুজ্জামান চাপাতি হাতে তাড়া করেছিলেন। পরে তিনিই পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমকে জানান, তাঁর ভাই হয়তো সন্তানকে চাপাতি দিয়ে খুন করে থাকতে পারেন। গতকাল তিনি বলেন, ‘আসলে সাফায়েতের তো অসুখ হইছিল। তার গায়ে কোপের চিহ্ন নেই। তখন রাগের মাথায় বলছিলাম। ভাইটারে জামিন করানো দরকার। অনেক টাকার ব্যাপার। বাড়ির চাবিটা পাইলে একটা ব্যবস্থা করা যাইত।’

এদিকে নুরুজ্জামানদের ভাড়াটেরা পড়েছেন আরেক যন্ত্রণায়। ওই ভবনের ভেতরে কয়েকটি গুদামে তাঁদের মালপত্র আছে। একজন ভাড়াটে বলেন, গুদামের ভাড়া মাসে ৮৪ হাজার টাকা। ভেতরে ১০ লাখ টাকার ওপর মালপত্র আছে তাঁর। হাতিরপুল টাইলসের মালিক হুমায়ুন কবিরের আছে ২০ লাখ টাকার মালামাল। তাঁরা কেউই মাল গুদাম থেকে বের করতে পারছেন না।

তবে যাঁরা চাবির সন্ধান করছেন, তাঁরা খুব সহজে চাবি পাচ্ছেন না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, নুরুজ্জামান জামিন পেলে চাবি দিয়ে দেবে পুলিশ। তাদের যুক্তি হলো, ওই জায়গায় জমির দাম অনেক। চাবিটা দিলে এখন ওয়ারিশদের মধ্যে খুনোখুনিও হতে পারে। নুরুজ্জামান কাজল ছেলেকে খুন করেছেন, এই খবরটাও তাঁদেরই একজন ছড়িয়েছিলেন। যদিও এখন পর্যন্ত এ তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। নুরুজ্জামান ফৌজদারি অপরাধে গ্রেপ্তার হলেও তাঁকে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি থেকে কেউ বঞ্চিত করুক, সেটা প্রশাসন চায় না।

পুলিশের রমনা বিভাগের প্রধান মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ‘সব পক্ষকে সামনে রেখে চাবি দেব।’