যত্রতত্র থামছে বাস, ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার

ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে মানুষ। সার্ক ফোয়ারা মোড়, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো
ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে মানুষ। সার্ক ফোয়ারা মোড়, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো

কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারার সামনের সড়কে তখনো সিগন্যাল পড়েনি। বাংলামোটর থেকে ধেয়ে আসছিল বেশ কয়েকটি বাস, অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত গাড়ি। এরই মধ্যে কয়েকজন পথচারী দৌড়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছিলেন। এ যাত্রায় কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলেও এভাবেই কিন্তু ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। এ দৃশ্য আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকের।

শুধু মানুষের যত্রতত্র পারাপারই নয়, যেখানে-সেখানে থামছে বাসগুলো। ইচ্ছেমতো সড়কের ওপরই যাত্রী তোলা হচ্ছে। মানুষও দৌড় দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে বাসে ওঠা-নামা করছে। এসব ঘটছে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই। ট্রাফিক পুলিশও নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরে জানালেন, মানুষ সচেতন না হলে শুধু আইন দিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে রাজধানীতে গতকাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে ১৫ দিনের ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ-২০১৯’, চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।

কারওয়ান বাজার সিগন্যালে বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে দেখা গেছে, জেব্রাক্রসিং ছাড়াই রাস্তা পারাপার হচ্ছে মানুষ। ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত যানবাহনের সামনে দিয়ে যখন-তখন রাস্তা পার হচ্ছে পথচারীরা।

সিগন্যাল ছাড়া এভাবে রাস্তা পারাপারের কারণ জানতে চাইলে এক ব্যক্তি বলেন, ‘হাতে অনেক কাজ। ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হবে। তাই এভাবে রাস্তা পার হলাম।’ আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘সবাই তো এভাবে পার হচ্ছিল। ওদের দেখাদেখি আমিও রাস্তা পার হলাম।’

একই স্থানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা গেল, নিউ ভিশন পরিবহনের একটি বাসের পেছনে ছুটছেন কয়েকজন মানুষ। দরজার হাতল ধরে ঝুঁকি নিয়েই চলন্ত বাসে উঠে পড়লেন কয়েকজন। শেষের ব্যক্তি হোঁচট খেয়ে আর বাসে উঠতে পারলেন না। পেছনেই আরেকটি বাস আসছিল। অল্পের জন্য দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলেন তিনি। কাছে গিয়ে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বাসে ওঠার কারণ জানতে চাইলে খেপে যান তিনি। ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, ‘কিছু হলে আমার হবে। আপনি এত নাক গলাচ্ছেন কেন? যান, নিজের কাজ করেন।’

বাস চলছেই, তবু ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে বাসে উঠছে মানুষ। ছবি: প্রথম আলো
বাস চলছেই, তবু ঝুঁকি নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে বাসে উঠছে মানুষ। ছবি: প্রথম আলো

বাংলামোটর বাস স্টপেজে গিয়ে দেখা গেছে, বাস থামার অনুমতি—নেই এমন স্থানে বাস থেমে যাত্রী ওঠাচ্ছে। চলন্ত বাসের দরজা বন্ধ থাকার কথা থাকলেও তা খোলা। পাশেই দায়িত্ব পালন করছে ট্রাফিক পুলিশ।

কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা হলে তাঁদের একজন বলেন, ‘মানুষও এমনে কইরা বাসে উঠতাছে। যাত্রী যদি এমনে কইরা না উঠাই, তাইলে তো না খায়া থাকতে হইব।’

আরেক চালকের ভাষ্য, ‘বাস কোনখানে থামাইতে হইব, কোনখানে চালু রাখতে হইব—সেইটাই তো বুঝি নাই। তাই থামাইছি।’

বাস টান দেওয়ার পর গেট বন্ধ করেননি কেন—জানতে চাইলে ওই চালক বলেন, ‘অনেক সময় বাস টান দেওয়ার পর মানুষ ছুইটা আসে, ওগো তো তুলতে হইব। মানুষরে বিপদে ফেইলা আমাগো কী লাভ?’

কারওয়ান বাজারে কথা হয় ট্রাফিক সার্জেন্ট আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, শুধু আইন করে সড়কে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়। বাসগুলো নির্দিষ্ট স্থানে থামার কথা থাকলেও থামছে না। আবার ঝুঁকি নিয়ে চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে মানুষ রাস্তা পারাপার হচ্ছে। এসব বিষয়ে মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। নাগরিককে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তাহলে শৃঙ্খলা ফিরবে।

পান্থপথ সিগন্যালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্য ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে মানুষ সচেতন নয়। কখন রাস্তা পার হতে হবে অনেকে জানে না। জেব্রাক্রসিং দিয়ে পারাপার হতে বললে অনেকে বলেন, জেব্রাক্রসিং কোনটা একটু দেখিয়ে দেন। আবার অনেক সময় বাসগুলো জেব্রাক্রসিংয়ের ওপর দাঁড়ায়। এতে মানুষ বিশৃঙ্খল হয়ে রাস্তা পারাপার হয়। বাসগুলো নির্দিষ্ট স্থানে না দাঁড়ানো সড়কের অন্যতম সমস্যা বলে মনে করেন আবদুল্লাহ।

জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপারের কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ছবি: প্রথম আলো
জেব্রাক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপারের কথা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ছবি: প্রথম আলো

গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাসচাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে সড়কে নামে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। পুলিশ ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা সে সময় মারধর করে তাদের উঠিয়ে দেন। তবে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সাড়া দেয় সরকারের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে বিশেষ অভিযানে নামে পুলিশ। গত ৪ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া নগরের যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনার ঘোষণা দিয়ে সেপ্টেম্বরকে ‘বিশেষ ট্রাফিক সচেতনতা মাস’ হিসেবে ঘোষণা দেন। এতে বাস চলাচলে শৃঙ্খলা আনা, জাহাঙ্গীর গেট থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত রাস্তা স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেতের আওতায় আনা, লেগুনা চলাচল বন্ধসহ বেশ কিছু সংস্কারের কথা বলেন। এক মাসের বিশেষ অভিযান শেষে মোটরসাইকেলচালক ও আরোহীদের মাথায় হেলমেট উঠলেও সার্বিক পরিস্থিতি তেমন বদলায়নি। মাস শেষে কমিশনারের নিজের মূল্যায়ন ছিল, মাসব্যাপী অভিযানে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি।

গতকাল এই পক্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘গত বছর সড়কে বাসচালকের দায়িত্বহীন ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ফলে কোমলমতি দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। এ ঘটনার পরে আমরা সড়কের বিশৃঙ্খলা দূর করতে এই জিরো পয়েন্টে বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহ উদ্বোধন করেছিলাম। আজও এখান থেকে “ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ” উদ্বোধন করা হচ্ছে।’

অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, এই সময় রাজধানীর ৫৭টি স্থানে চৌকি বসিয়ে কার্যক্রম চালাবে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। সড়কে যানজটের জন্য কিছু সমস্যার সমাধান করা জরুরি। তার মধ্যে রয়েছে ভৌত কাঠামোর উন্নয়ন, ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থার সংস্কার এবং যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করা।

বক্তব্য শেষে বেলুন উড়িয়ে ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষের উদ্বোধন করা হয়। এরপর সচেতনতামূলক লিফলেট যাত্রী ও চালকের মধ্যে বিতরণ এবং বিভিন্ন গাড়িতে সচেতনতামূলক স্টিকার লাগানো হয়।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকেরা। ছবি: প্রথম আলো
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকেরা। ছবি: প্রথম আলো

সেপ্টেম্বরে বাস চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে নগরীতে চুক্তিতে বাস না চালানোর কথা বলেছিলেন পুলিশ কমিশনার। বাসমালিকদের নেতারাও ঢাকায় দৈনিক চুক্তির ভিত্তিতে বাস না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার বদলে বেতনভুক্ত চালক ও কর্মী রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তা আর কার্যকর হয়নি।

এবারের পরিকল্পনা
এবার ঢাকা মহানগরের ট্রাফিক-সংক্রান্ত ভৌত অবকাঠামোর ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পর্যায়ক্রমে নগরের বেদখল হওয়া রাস্তা উদ্ধার, রাইড শেয়ারিং অ্যাপে চলা যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

ফার্মগেট থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত রাস্তাটিকে গাড়ি চলাচলের জন্য পুরোপুরি খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রাস্তাটির ওপরে ট্রাক রেখে স্ট্যান্ড বানানো হয়েছিল। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ওই রাস্তা থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করেছিলেন।

এই পক্ষে মডেল করিডর হিসেবে ঘোষিত বিমানবন্দর থেকে শহীদ জাহাঙ্গীর গেট, ফার্মগেট, সোনারগাঁও, শাহবাগ, মৎস্য ভবন, কদম ফোয়ারা, পুরাতন হাইকোর্ট হয়ে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ভিআইপি সড়কের সংযোগগুলোয় রিমোট নিয়ন্ত্রিত ও স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বাতি কার্যকর করা হবে।

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ২৯টি পয়েন্টে চেকপোস্টের কার্যক্রম চলবে, গুরুত্বপূর্ণ ৩০টি পদচারী-সেতু ব্যবহারে পথচারীদের উদ্বুদ্ধকরণে পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবেন। স্টপেজ ছাড়া অন্য সময় চলন্ত বাসের দরজা বন্ধ থাকবে। স্টপেজ ছাড়া যত্রতত্র বাস থামলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাঁ পাশের লেন ঘেঁষে নির্ধারিত স্টপেজেই যাত্রী ওঠানামা করাতে হবে।

আরও পড়ুন: