যে বাজারে গবেষণা কেনাবেচা হয়

প্রিন্ট ও বাঁধাইয়ের এসব দোকানে গবেষণাপত্র তৈরি ও বিক্রি করেন অধিকাংশ দোকানি। সম্প্রতি নীলক্ষেত এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
প্রিন্ট ও বাঁধাইয়ের এসব দোকানে গবেষণাপত্র তৈরি ও বিক্রি করেন অধিকাংশ দোকানি। সম্প্রতি নীলক্ষেত এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
>
  • স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণার কোর্স থাকে
  • নীলক্ষেতের দোকানগুলোতে চুরি করা গবেষণাপত্র বিক্রি
  • মৌলিক গবেষণা চুরি করে নতুন থিসিসের রূপ দেওয়া হয়
  • ইন্টারনেট থেকেও বিভিন্ন গবেষণার কপি সংগ্রহ করা হয়
  • ফরমাশ করলে শিক্ষার্থীদের সাহায্যে তাও বানায় দোকানিরা

‘ভাই কী লাগবে? এই দিকে আসেন!’
‘থিসিস আছে?’
‘প্লাস্টিক কার্ড তো?’
‘হুম’
‘এই দিকে আসেন।’
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পরিচয়ে নীলক্ষেতের সিটি করপোরেশন মার্কেটের তৃতীয় গলিতে ছাপা ও বাঁধাইয়ের একটি দোকানে গবেষণাপত্রর খোঁজ করছিলেন এই প্রতিবেদক। দোকানির ভাষায় সেটাই প্লাস্টিক কার্ড।

কিন্তু সাংকেতিক ভাষা কেন? নীলক্ষেতের এ দোকানগুলোতে চুরি করা গবেষণাপত্র তথা থিসিস বিক্রি হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী পানির দরে তা কিনে নিজের গবেষণা হিসেবে জমা দেন। এ অভিযোগের সত্যতা অনুসন্ধানের শেষে প্রমাণ সংগ্রহের জন্যই গত ১৬ নভেম্বর ছদ্মপরিচয়ে সেখানে প্রতিবেদকের যাওয়া।

ক্রিকেট অথবা সামাজিক বিজ্ঞানের যেকোনো বিষয়ে থিসিস চাইলে দোকানি কম্পিউটার ঘেঁটে একটি পিডিএফ কপি দেখান। সেটায় মূল লেখকের নাম ছিল না। দোকানি সফট কপির দাম চাইলেন ১৫০ টাকা। আর সম্পাদনা, প্রিন্ট ও বাঁধাই বাবদ ৮০০ টাকা। দাম রফা হলে তিনি থিসিসটিকে পিডিএফ থেকে ওয়ার্ড ফাইল করলেন। তারপর গবেষণার সূচনা ও সাক্ষাৎকারদাতাদের নাম রদবদল আর বিভিন্ন অনুচ্ছেদ ওপর-নিচ করা বা বাদ দেওয়ার কাজ চলল। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল স্নাতকোত্তর শ্রেণির একটি গবেষণাপত্র।

গত ১২ ও ১৪ নভেম্বর এই বাজার ঘুরে এমন অন্তত ২১টি দোকানের খোঁজ পাওয়া যায়। সাইনবোর্ডগুলোতে লেখা ‘এখানে থিসিস, মনোগ্রাফ, টার্মপেপার প্রিন্ট ও বাঁধাই করা হয়’।

পরিচিত একজন দোকানি বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মৌলিক গবেষণাপত্র চুরি করে নতুন থিসিসের রূপ দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা দোকানে গবেষণাপত্র ছাপাতে ও বাঁধাই করতে এলে সেটার একটি সফট কপি তাঁরা রেখে দেন। ইন্টারনেট থেকেও বিভিন্ন গবেষণার কপি সংগ্রহ করেন।

কয়েকজন দোকানি বলেন, বিশেষ চাহিদা জানিয়ে ফরমাশ করলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য নিয়ে তাঁরা সেটাও বানিয়ে দেন। দাম পড়ে চার হাজার টাকা। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি—এই ছয় মাস বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার কোর্স পড়ানো হয়। এটাই ব্যবসার মৌসুম।

দুদিনে চার ঘণ্টা নীলক্ষেতে বিভিন্ন দোকানে ঘুরেছেন এই প্রতিবেদক। তখন তিনটি দোকান থেকে সাতজনকে থিসিস কিনতে দেখেছেন। তাঁদের চারজনের পরিচয় জানা যায়। দুজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, একজন স্ট্যামফোর্ড আর একজন প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী।

শেষোক্ত শিক্ষার্থী পর্যটনবিষয়ক থিসিস খুঁজছিলেন। দোকানি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একটি থিসিস দেখান। পছন্দ না হওয়ায় শিক্ষার্থী দুই নম্বর গলির আরেকটি দোকানে যান। সেখানে ২০১২ সালে করা একটি থিসিস তাঁর পছন্দ হয়। দাম ঠিক হয় ৮০০ টাকা। তাঁর চাহিদামতো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ও তারিখসহ রদবদল করে দেন দোকানি।

দুই দিন পর মুঠোফোনে এ শিক্ষার্থীর সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে নাম না প্রকাশের অনুরোধ করে তিনি বলেন, ‘ওই থিসিস জমা দেইনি। আমার গবেষণার বিষয়ের সঙ্গে মিলে নাই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ড হলো গবেষণা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে পিএইচডি চুরির অভিযোগ ওঠে, শিক্ষার্থীদের থিসিস বিক্রি হয় রাস্তার ধারের দোকানে। রাস্তাতেই যদি গবেষণা হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কি দরকার?’

মৌলিক জ্ঞানচর্চা শেখানোর জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণার কোর্স থাকে। মৌলিক বিষয় নির্বাচন থেকে মাঠে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা এবং গবেষণা প্রতিবেদন লেখার কাজটি শিক্ষার্থী করেন একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। তিনি ছয় মাস থেকে এক বছর সময় পান। নীলক্ষেতে গবেষণাপত্র কিনলে এর কিছুই করতে হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকেরা রচনাচুরি (প্লেজ্যারিজম) ধরার জন্য বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। কিন্তু দোকানিরা বলেছেন, তাঁরাও একই ধাঁচের সফটওয়্যার ব্যবহার করে রচনাচুরি ধরা পড়ার সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলো শনাক্ত করেন। তারপর সেগুলো এদিক-সেদিক করে রচনাচুরির আলামত কমানো হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের গবেষণা তত্ত্বাবধান করেছেন অধ্যাপক ফাহমিদুল হক। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা জালিয়াতি শিখে পাশ করলে কর্মক্ষেত্রেও তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নেবেন। এই দুই শিক্ষকেরই মত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন খুব কম গবেষণা হয়। চুরি করা গবেষণাপত্রের কেনাবেচা চলতে থাকলে সেটুকুও হবে না।

২০১৭ সালের নভেম্বরে এই অনুসন্ধানের গোড়ায় নীলক্ষেতে একই বাজারের দুই নম্বর গলিতে গিয়ে প্রতিবেদক এক দোকানিকে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর জন্য থিসিস সম্পাদনা করতে দেখেন। প্রতিবেদক জরুরি ভিত্তিতে ক্রিকেটবিষয়ক একটি থিসিসের সফট কপি কিনতে চান। দোকানি ‘প্রেডিক্টিং এ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচ রেজাল্ট হোয়াইল দ্যা ম্যাচ ইজ ইন প্রোগ্রেস’ নামের একটি গবেষণাপত্র দশ মিনিটের মধ্যে কিছু রদবদল করে পেনড্রাইভে দিয়ে দেন।

গবেষণাপত্রের প্রচ্ছদে লেখক হিসেবে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের চার শিক্ষার্থীর নাম ছিল। তাঁরা ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিসটি জমা দিয়েছিলেন। আর দোকানটির কম্পিউটারে এর ফাইল ঢুকেছিল (ক্রিয়েটেড) ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর।

গত ১৬ নভেম্বর গিয়ে দেখা যায়, এ যাবৎ থিসিসটি ছয়বার সম্পাদিত ও বিক্রি হয়েছে। গবেষণাটির সহ-তত্ত্বাবধায়ক প্রভাষক মঈন মোস্তাকিম বলছেন, গবেষণাটি করতে এক বছর লেগেছিল। গবেষণাপত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। সেখান থেকে অথবা প্রিন্ট করার সময় সেটি চুরি হয়ে থাকতে পারে।

এই শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণায় বেশ কিছু জটিল গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল। সাধারণ একজন দোকানি কীভাবে গবেষণা সম্পাদনা করেছেন, সেটিই তো মাথায় ঢুকছে না।’

শিক্ষার্থীরা কেন নীলক্ষেতমুখী?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ সালে স্নাতকোত্তর পাস করা এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিচিত বড়ভাইয়ের মাধ্যমে নীলক্ষেতে গবেষণা তৈরির কথা শুনি। পরে সেখান থেকে কিনে বিভাগে জমা দিয়েছিলাম।’ রচনাচুরি ধরা পড়ায় প্রথমে তাঁর গবেষণাপত্রটি গৃহীত হয়নি। শিক্ষকেরা সংশোধন করে আনতে বললে তিনি দোকান থেকে রচনাচুরির হার কমিয়ে এনে জমা দেন। আর সমস্যা হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীর গবেষণা জালিয়াতি ধরা পড়লে বিভাগীয় পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়াটাই রেওয়াজ। নৃবিজ্ঞান বিভাগ ২০১৬-১৭ সালে চারজন শিক্ষার্থীকে জালিয়াতির জন্য জরিমানা করেছিল। তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান হাসান আল শাফী প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছরই পাঁচ-ছয়জন শিক্ষার্থীর মনোগ্রাফ ও থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে তাঁদের সফটওয়্যার বাংলা লেখায় রচনাচুরি ধরতে পারে না।