পুরুষদের পেছনে ফেলেছেন নারীরা

>

• এ বছর মেডিকেলে ১০ হাজার ২২৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন
• ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৬০ শতাংশ ছাত্রী, ছাত্র ৪০ শতাংশ
• মেডিকেলে ছাত্রী বেশি ভর্তি হচ্ছে, ছাত্রীরা পাসও করছেন বেশি
• এমবিবিএস পাসের ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থানগুলোও ছাত্রীদের দখলে
• নারী চিকিৎসকদের ৯৬% বিশেষ দক্ষ স্ত্রী–প্রসূতিরোগ বিষয়ে

চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবার ক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা পুরুষকে ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে চলতি শিক্ষাবর্ষে ২২০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৩৬ জন ছাত্রী, ছাত্র মাত্র ৮৪ জন। আবার ১০ বছরে পুরুষের তুলনায় এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনকারী নারীর সংখ্যাও প্রায় ৩ হাজার বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এটাই এখন চিকিৎসা শিক্ষা ও চিকিৎসা পেশার চিত্র। এ বছর মেডিকেল কলেজগুলোতে ১০ হাজার ২২৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের প্রায় ৬০ শতাংশ ছাত্রী, ছাত্র ৪০ শতাংশ।

২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মেডিকেল কলেজে ভর্তি ও এমবিবিএস পাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মেডিকেলে এখন ছাত্রী বেশি ভর্তি হচ্ছে। ছাত্রীরা পাসও করছেন বেশি। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এর প্রভাবের বিষয়ে এখনই নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

এখন এমবিবিএস পাসের ক্ষেত্রে ছাত্রীরা শুধু সংখ্যায় বেশি তাই না, শীর্ষ স্থানগুলোও তাঁরা দখল করছেন। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করা শীর্ষ ১০ জন শিক্ষার্থীর ৮ জন ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের। কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, ওই আটজনের সাতজনই ছাত্রী। এই ধারা বেশ কয়েক বছর চলছে।

ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবির) গবেষণা বলছে, এমবিবিএস পাস করা ৯১ শতাংশ নারী চিকিৎসক স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি নিতে আগ্রহী। মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষকস্বল্পতা থাকলেও নারীদের তাতে আগ্রহ নেই। গ্রামে এখনই চিকিৎসক রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নারী চিকিৎসক বাড়লে সেই সমস্যা আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীরা বলেছেন, তাঁরা শহুরে পরিবেশে থাকতে পছন্দ করেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। সরকার মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যসেবার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে নারী চিকিৎসকদের সংখ্যাধিক্য খারাপ কিছু নয়।’

প্রসূতিরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ফিরোজা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, মেধার জোরেই মেয়েরা ভর্তি ও পাসের ক্ষেত্রে ছেলেদের পেছনে ফেলছে। এখন ভারসাম্য রক্ষা করতে ছেলেদের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে।

ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে
২০০৭ সাল থেকে মেডিকেলে ভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্রীরা সংখ্যায় ছাত্রদের ছাড়িয়ে যান। ওই বছর (২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষ) দেশের সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে ৪ হাজার ৩৯৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন। এর মধ্যে ছাত্র ছিলেন ২ হাজার ১৬৭ জন ও ছাত্রী ২ হাজার ২২৮ জন। ছাত্রী বেশি ছিলেন ৬১ জন। ছাত্রী ও ছাত্রের হার ছিল যথাক্রমে ৫১ ও ৪৯ শতাংশ। চলতি শিক্ষাবর্ষে ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১০ বছরে (২০০৭-১৬ সাল) মেডিকেল কলেজগুলো থেকে মোট ৩৯ হাজার ২৮৫ জন বাংলাদেশি এমবিবিএস ডিগ্রি নিয়ে বের হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছাত্র ২১ হাজার ১২৩ জন এবং ছাত্রী ১৮ হাজার ১৬২ জন। অর্থাৎ এই সময়ে পুরুষের চেয়ে ২ হাজার ৯৬১ জন বেশি নারী চিকিৎসক ডিগ্রি নিয়েছেন।

পরিসংখ্যান বলছে, আগামী বছরগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৬-২৭ সাল নাগাদ প্রতিবছর পুরুষ চিকিৎসকের দ্বিগুণ নারী চিকিৎসক ডিগ্রি নেবেন।

কেন ছাত্রী বেশি
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের ডিন অধ্যাপক খান আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, মেধার জোরেই মেয়েরা সংখ্যায় বেশি ভর্তি হচ্ছে, বেশি পাস করছে। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতামূলক ভর্তি পরীক্ষার ভিত্তিতে জাতীয় মেধাক্রম তৈরি হচ্ছে। এতে ছাত্রীদের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজকে দেশের সেরা মেডিকেল কলেজ বিবেচনা করা হয়। মেধাতালিকার শীর্ষে থাকা শিক্ষার্থীরা এখানে ভর্তি হয়। ভর্তি হওয়া ছাত্রের সংখ্যা ছাত্রীদের প্রায় অর্ধেক এখন।

অন্য একটি কারণে ছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা শাখার সহকারী পরিচালক মো. মাসুদুর রহমান। পাঁচটি মেডিকেল কলেজ প্রতিবছর শুধু ৪৯০ জন করে ছাত্রী ভর্তি করছে। ছাত্রীর হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে এর ভূমিকা আছে।

গবেষণার তথ্য
২০০৬ থেকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) নিবন্ধিত ৩৪ হাজার ৬৯৭ জন চিকিৎসকের তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ও আইসিডিডিআরবির গবেষকেরা দেখেছেন, এঁদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ পুরুষ চিকিৎসক ও ৫২ শতাংশ নারী চিকিৎসক। পুরুষ চিকিৎসকদের ৮৭ শতাংশের বিশেষ দক্ষতা মেডিসিন ও সার্জারি বিষয়ে। আর নারী চিকিৎসকদের ৯৬ শতাংশের বিশেষ দক্ষতা স্ত্রী ও প্রসূতিরোগ বিষয়ে। ২১ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রবন্ধ ১১ জানুয়ারি অনলাইন মেডিকেল জার্নাল প্লজ ওয়ান-এ প্রকাশিত হয়েছে।

ওই গবেষণায় এমবিবিএস শেষ বর্ষের সরকারি মেডিকেলের ২০৭ জন ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ১০৭ জন ছাত্রীর ওপর জরিপ করা হয়। জরিপে অংশ নেওয়া ছাত্রীদের ৯৩ শতাংশ ছিলেন শহরের। ছাত্রীদের ৯৪ শতাংশ বলেছিলেন, সামাজিক মর্যাদার কারণে তাঁরা চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁদের ৪২ শতাংশ এ-ও বলেন, এই পেশা বেছে নেওয়ার পেছনে বাবা-মায়ের চাপ ছিল। ১৭ শতাংশ বলেছিলেন, বিয়ের বাজারে এই পেশার দাম আছে।

গবেষকদের সঙ্গে দলগত আলোচনায় ছাত্রীরা পেশা চর্চার ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেন, বিয়ের পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মনে করেন, চিকিৎসা পেশা চর্চার চেয়ে পারিবারিক দায়িত্ব পালন করা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রায় সব ছাত্রী কিছু বৈষম্যের কথাও বলেছেন। তাঁরা দেখেছেন, রোগীদের একটি ধারণা আছে যে নারী চিকিৎসকের তুলনায় পুরুষ চিকিৎসক বেশি দক্ষ। এমনকি প্রতিযোগিতামূলক পড়ালেখায় পিছিয়ে থাকা পুরুষ সহকর্মীরাও মনে করেন, নারী চিকিৎসকেরা ‘কম সফল’।

কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার সমস্যার কথাও বলেছেন অনেকে। অধিকাংশ ছাত্রী কর্মক্ষেত্র হিসেবে শহর বা শহরের আশপাশ এলাকাকে পছন্দের তালিকায় রেখেছেন। সরকারি চাকরি হলেও তাঁরা শহরেই থাকতে চান। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় শহরের যে পরিবেশ পেয়েছেন, তাঁরা তা ছাড়তে চান না। তাঁরা মনে করেন, গ্রামে আবাসন সমস্যা প্রকট। গ্রামে চিকিৎসকদের নিরাপত্তারও ঘাটতি আছে।

গবেষণা প্রবন্ধে সংখ্যা উল্লেখ না করে গবেষকেরা বলেছেন, এমবিবিএস পাস করলেও অনেক নারী চিকিৎসক পেশা চর্চার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান, অনেকে পেশা ছেড়ে দেন। তাই ছাত্রী যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সে অনুপাতে নারী চিকিৎসক না-ও বাড়তে পারে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এই প্রবণতা আছে বলে প্রবন্ধে বলা হয়।

মেডিকেল শিক্ষা ও পেশায় নারীদের এই আধিক্যকে ইতিবাচক বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় অধ্যাপক শাহ্লা খাতুন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘মেডিকেল শিক্ষা ও পেশা চর্চার ক্ষেত্রে মেয়েরা অনেক বেশি নিবেদিতচিত্ত ও আন্তরিক। পরিবারের অনেক দায়িত্বপালন করার পর তারা ক্লাসে আসে, হাসপাতালে কাজ করে, ফাঁকি দেয় না। বর্তমান সমাজ এখানে মেয়েদের অনেক সমর্থন দিয়েছে। আমি চাই আরও মেয়ে এই পেশায় আসুক।’

এটা কি সমস্যা?
গবেষণা দলের অন্যতম সদস্য ও ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষণা সহযোগী রজত দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, মেডিকেলে ছাত্রী বেশি আসছে, নারী চিকিৎসকের সংখ্যাও বাড়ছে—এটা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে বেশি সংখ্যায় নারী চিকিৎসককে কাজে লাগানোর জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রস্তুত কি না, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

তরুণ এই গবেষক বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রধান সমস্যা দুটো। হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে হয়, কিন্তু নারী চিকিৎসকদের রাতের পালায় দায়িত্ব পালনে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। অন্যদিকে, সরকার পুরুষ চিকিৎসকদের জন্য গ্রামপর্যায়ে নিরাপদ থাকার ব্যবস্থা করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে নারী চিকিৎসকদের তৃণমূলে পদায়ন করায় সমস্যা হবে।

তবে স্বাস্থ্যসচিব আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এটা ব্যবস্থাপনার বিষয়। অবকাঠামো উন্নয়ন ও নীতি পর্যায়ে সমন্বয় করে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে। নতুন স্বাস্থ্য জনশক্তি কর্মপরিকল্পনায় বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এটা সত্য যে সেবার ক্ষেত্রে নারী চিকিৎসকেরা ভালো।’

ব্র্যাক ও আইসিডিডিআরবির গবেষণা দলের সমন্বয়কারী সৈয়দ মাসুদ আহমেদ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, স্বাস্থ্যসেবায় নারী চিকিৎসক বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে রোগী, পেশা ও সমাজের ওপর। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন ও সেবার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা-অসুবিধা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে সুবিধাকে কাজে লাগাতে হবে, অসুবিধা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।