ভিন্ন রকম গরু পালনে লাভের পাল্লা ভারী

নরসিংদীর রাধানগর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের আমিন তালুকদার ওরফে রুবেলের গরুর খামার। ছবি: প্রথম আলো
নরসিংদীর রাধানগর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের আমিন তালুকদার ওরফে রুবেলের গরুর খামার। ছবি: প্রথম আলো

ভিন্ন পন্থায় খামার গড়ে এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত। অন্য খামারিদের মতো গৎবাঁধা নিয়মে আবদ্ধ জায়গায় গরু বেঁধে রাখেন না। তাঁর খামারের গরু ঘুরে বেড়ায় নির্দিষ্ট বেষ্টনীর চারপাশে। তিনি নরসিংদীর রাধানগর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের আল আমিন তালুকদার ওরফে রুবেল। প্রথম আলোকে জানালেন, এভাবে গরু পালনে বিপুল লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখেছেন।

২০০৩ সালে লেখাপড়ার পর্ব শেষ করে রুবেল ভেবেছিলেন, দুই ধরনের খামার গড়ে তুললে হয়তো লাভের দেখা সহজেই মিলবে। তাই সবজির পাশাপাশি ১৪টি গরু নিয়ে খামার গড়েন পৈতৃক জায়গায়। কিন্তু ভাগ্য সহায় ছিল না। পাঁচ বছরের মধ্যে ১৫ লাখ টাকা লোকসানের বোঝা চেপে বসে তাঁর কাঁধে। বাধ্য হয়ে গরুর খামার বন্ধ করে দেন। তবে কৃষিপ্রধান এলাকা লক্ষ্মীপুরে সবারই যেন কৃষিকাজে রয়েছে দুর্বলতা। সেই দুর্বলতা থেকে ২০১১ সালে আবারও গরুর খামার শুরু করেন। তবে এবার তাড়াহুড়া নয়, ভাবনা-চিন্তা করেন রুবেল। গো-খামার নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিন বছরের মধ্যে লোকসানের বোঝা সরিয়ে লাভের দেখা পান।

বেষ্টনীতে ছেড়ে রেখে গরু পালন
আমিন তালুকদার জানান, কয়েক বছর আগে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কয়েকটি রাজ্যের খামার দেখতে যান। ভারতের বিহার, হরিয়ানা, পাঞ্জাবের খামার দেখে গরু পালনের ধরন বদলে ফেলেন। দেখতে পান, সেসব রাজ্যে গরু-মহিষগুলো খামারের একটি বেষ্টনীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যখন খিদে লাগছে, পশুগুলো খেয়ে নিচ্ছে নিজের মতো করে। কোনো আবদ্ধ জায়গায় গরু-মহিষকে গলায়-মুখে দড়ি বেঁধে ঠায় দাঁড়িয়ে কিংবা বসিয়ে রাখা হয় না। পশুগুলোর স্বাস্থ্য বেশ ভালো, প্রচুর দুধও দিচ্ছে। মাত্র দুই-তিনজন রাখাল দিয়ে শতাধিক গরু লালন-পালন করানো হয়। ঘাস, ভুসি, গমই খেতে দেওয়া হচ্ছে। দেশে ফিরে আরও কয়েকজন খামারির সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেন। এবার নিজের খামারে বেষ্টনী নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এক বিঘার খামারের মধ্যে পাঁচ কাঠা জায়গায় গড়েন এই বেষ্টনী। একপাশে ঢেউটিন দিয়ে ছোট্ট একটু শেড। গোটা বিশেক গাভি ও বাছুর বেষ্টনীর ভেতরে ছেড়ে দেন।

আমিন বলেন, বেষ্টনীর ভেতর গরু ছেড়ে দিয়ে তিনি বেশ উপকার পাচ্ছেন। এ কৌশল খাঁটিয়ে গরুগুলোর কাছ থেকে প্রচুর দুধ মিলছে। তবে দুধের দাম খুব একটা না পাওয়ায় এবার দুধের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উন্নত জাতের বাছুর প্রজননে মনোযোগ দেন তিনি। উন্নত জাতের সিমেন (বীজ) বাইরে থেকে আমদানি করেন। এর মধ্যে গিরল্যান্ডো নামের একটি জাত রয়েছে।

আমিন বলেন, ‘২০০৩ সালে আমাকে ১৪টি গরু দেখাশোনা করাতে দুজন শ্রমিককে বেতন দিতে হতো। এখন ৪০টি গরু রয়েছে আমার খামারে। কিন্তু লোকবল এখন আগের মতো দুজনই রয়েছে।’

বেষ্টনীর ভেতরে ছাড়া অবস্থায় থাকে আমিনের খামারের গরুগুলো। ছবি: প্রথম আলো
বেষ্টনীর ভেতরে ছাড়া অবস্থায় থাকে আমিনের খামারের গরুগুলো। ছবি: প্রথম আলো

বেষ্টনীর ভেতর গরু ছেড়ে পালন করলে তিন ধরনের সুবিধা রয়েছে বলে মনে করেন আমিন। তিনি বলেন, প্রথমত গরুর মধ্যে চাঞ্চল্য থাকে। মনমরা হয়ে থাকে না। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, বেশি গরু পালন করা যায়, গোবর দিনে দুবার পরিষ্কার করলেই হয়। তাই শ্রমিক খরচ অনেকটাই কমে যায়। তৃতীয়ত, প্রাণচাঞ্চল্য থাকায় গরুর রোগ–বালাই কম হয়। এর ফলে চিকিৎসার ব্যয় কমে যায়। সব মিলিয়ে গরুর দুধ উৎপাদন বেশি হয়।

আমিন জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গিরল্যান্ডো জাতের বীজ এনেছেন। বেষ্টনীর মধ্যে থাকা গাভিগুলোর মাধ্যমে নতুন জাতের বাছুর পাওয়ার আশা করছেন। বাছুরের সঙ্গে প্রতিটি গাভি থেকে বছরে প্রায় ১৩ হাজার লিটার দুধ পাওয়া যাবে বলে তাঁর আশা। তাঁর মতে, গরু বেঁধে পালন করতে হলে জায়গা তুলনামূলক বেশি প্রয়োজন হয়। বর্জ্য সরানোর জন্য আলাদা নালা করতে হয়। কিন্তু খোলা জায়গায় ছেড়ে দিয়ে রাখলে কম জায়গায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেশিসংখ্যক গরু পালন করা যায়।

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নতুন পন্থায় বেষ্টনীতে ছেড়ে দিয়ে রেখে গরু পালন করছেন আমিন। তিনি বলেন, প্রতিদিন এক শ লিটার দুধ পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি লিটার দুধ ৫৪ টাকায় বিক্রি করে দৈনিক আয় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। প্রতিবছর সাত–আটটি বাছুর বিক্রি করে প্রায় আড়াই লাখ টাকা আয় হয় তাঁর।

নিজের খামারে আমিন তালুকদার। ছবি: প্রথম আলো
নিজের খামারে আমিন তালুকদার। ছবি: প্রথম আলো


গোবর থেকে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট
আমিন তালুকদারের খামারের গরু থেকে প্রচুর পরিমাণে গোবর পাওয়া যায়। ওই গোবরগুলো কাজে লাগানোর জন্য খামারে একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছেন তিনি। এই প্ল্যান্ট থেকে পাঁচটি লাইনে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিটি লাইন থেকে মাসে আট শ টাকা পাচ্ছেন। গ্যাস পাওয়ার পর গোবর ফেলে দেন না তিনি। সবজির খামারের জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করেন। তাই দুই বিঘা জমি বর্গা নিয়ে কৃষি খামারের পরিধি বাড়িয়েছেন। চার বিঘা আয়তনের খামারে কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করছেন। এ ছাড়া খামারের আরেক অংশে ভুট্টা, নেপিয়ার ঘাসের চাষ করা হচ্ছে। এই ঘাস ও ভুট্টা দিয়ে খামারে গো–খাদ্যের জোগানও পাচ্ছেন। শুধু দুধ ও গ্যাস বিক্রি করে তাঁর বছরে আয় ২০ লাখ টাকা।

আমিন বলেন, ‘আমার ছোট ভাই আল হাদি পাভেল গরুগুলোকে দেখাশোনা করে, চিকিৎসা দেয়। সে মাস্টার্সে পড়াশোনা করছে। নিজের ভাই হলেও পাভেলকে মাসে ২৫ হাজার টাকা বেতন দিচ্ছি। এই টাকা দিয়ে পাভেল তার লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে।’

আমিনের আশা, গিরল্যান্ডো জাতের বাছুরের জন্ম হলে, তাঁর খামারে দুধ উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই আয় আরও বেড়ে যাবে। খামার ঘিরে তাঁর স্বপ্ন, প্রত্যাশা দিন দিন বাড়ছে, তাই খামারের নাম রেখেছেন ‘হোপ অ্যাগ্রো’।

আমিনের পথে ইমরান
আমিন তালুকদারের মতো বেষ্টনীতে গরু ছেড়ে পালন করছেন আরেক খামারি শাহ ইমরান। তবে তিনি মূলত মাংস উৎপাদনের জন্য খামার করেছেন। তাঁর ৫০টি গরুর একটি খামার রয়েছে গাজীপুর জেলার মাওনায়। এর মধ্যে রয়েছে দেশি জাতের উন্নত ও শাহিওয়াল ক্রস জাতের গরু। কোরবানির ঈদসহ যেকোনো উপলক্ষ সামনে রেখে শাহ ইমরান এসব গরু পালন করেন।

ইমরান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেষ্টনীতে ছেড়ে গরু পালন আমাদের দেশে এক নতুন অভিজ্ঞতা। ২৪ দিনে শাহিওয়াল ও ফ্রিজিয়ান ক্রস গরুর ওজন বৃদ্ধি পাওয়া গেছে ৪৪ কেজি। ৪৪৫ কেজি থেকে ওজন বৃদ্ধি পেয়ে ৪৮৯ কেজি হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন ওজন বেড়েছে ১৮৩০ গ্রাম করে।

তবে এ ক্ষেত্রে খাদ্য ব্যবস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন আনার কথা জানান ইমরান। তিনি বলেন, গমের ভুসি ১০ শতাংশ কমিয়ে ভুট্টা ১০ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সয়াবিন ও রাইস ব্রান দেওয়া হয়। একইভাবে অন্যান্য গরুর ওজন দৈনিক সোয়া কেজি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান তিনি।

খাবার থাকে বেষ্টনীর মধ্যেই। ঘুরেফিরে খাবার খায় গরুগুলো। ছবি: প্রথম আলো
খাবার থাকে বেষ্টনীর মধ্যেই। ঘুরেফিরে খাবার খায় গরুগুলো। ছবি: প্রথম আলো

ইমরান জানান, এভাবে বেষ্টনীতে ছেড়ে দিয়ে গরু পালন করলে গরুর মাংসে চর্বি কম জমে। মাংস সুস্বাদু হয়। হাঁটাচলা করায় গরুর পেটে গ্যাস কম জমে। তাই অসুখ-বিসুখ কম হয়। তবে এক বছর সময় ধরে বেষ্টনীতে গরু ছেড়ে দিয়ে পালতে হবে। বেষ্টনীর চারপাশে খাবারের পাত্র থাকবে। সেখান থেকে গরুগুলো নিজের মতো করে খেয়ে নেবে। এভাবে গরু পালন করলে শেড নির্মাণে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হবে না। তিনি বলেন, ‘অনেকে আছেন ৫০টি গরুর জন্য ২৫ লাখ টাকা দিয়ে খামারের শেড নির্মাণ করেন। এ জন্য অনেক সময় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়। এভাবে খামারের কাঠামো পাওয়া যায়, কিন্তু গরু আর পালন করা যায় না। উঁচু স্থানে বেষ্টনী করা ভালো। তবে পানি জমে গেলে বালু বা মাটি ফেলে জায়গা উঁচু করা যেতে পারে। অবশ্য অল্প কাদায় গরুর হাঁটাচলায় সমস্যা হয় না।’

বেষ্টনীতে ছেড়ে দিয়ে গরু পালনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হীরেশ রঞ্জন ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, ছেড়ে দিলে গরু-মহিষ হাঁটাচলা করতে পারে। এতে গরুগুলোর ব্যায়াম হয়। স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের গবেষণাও আছে।
মহাপরিচালক বলেন, ‘এভাবে পালনের সমস্যা হচ্ছে আমাদের ভূমি–সংকট। অন্য দেশে খামারে গবাদিপশু ছেড়ে দিয়ে পালন করা হয়। আমাদের দেশে এই সুযোগ কম। এটি পাওয়া গেলে আমাদের খামারিরা মাংস ও দুধ উৎপাদনে আরও এগিয়ে যেতে পারতেন।’