বিশ্বে 'রেইনবো টি' পরিচিত করতে চান সিলেটের সাইফুল

এক কাপে সাত রঙের চা। ছবি: ফেসবুক।
এক কাপে সাত রঙের চা। ছবি: ফেসবুক।

সকালে ঘুম ভেঙে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই অনেকের দিন শুরু হয়। এক কাপ চায়ে নাকি সারা দিনের এনার্জিও পান অনেকেই। শুধু সকালে নয়, দিনে কয়েকবার চায়ের কাপে চুমুক না দিলে যেন হয় না। অফিস হোক বা বিকেলের আড্ডা, চা ছাড়া কিন্তু জমে না৷ বেশি চা খেলে আবার অনেকের বুকজ্বালা ও গ্যাসের সমস্যাও হয়ে থাকে৷ গত শতাব্দী থেকে ঐতিহ্যের সঙ্গে চায়ের স্বাদ উপভোগ করে আসছে মানুষ। সৌদি গণমাধ্যম ‘আরব নিউজ’ বাংলাদেশের চা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। আসলে প্রতিবেদনটি মূলত এক কাপের সাত রঙের যে চা পাওয়া যায় তা নিয়েই।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সাত রঙা’ চা বাংলাদেশের চা-প্রেমীদের মধ্য স্বাদের বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। ঢাকাসহ দেশের অনেক এলাকায় তৈরি হয় সাত রঙা চা। ওই এক কাপ চায়ে সাত রঙে সাত ধরনের স্বাদ রয়েছে। সিলেটে সাত রঙের এই চা-কে ‘রেইনবো টি’ বলা হয়। সিলেটের এই চা এখন রাজধানী ঢাকায় দিনকে দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। এই চা প্রথম বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া সাইফুল ইসলাম বিশ্বে এ চা-কে পরিচিত করতে চান।

রাজধানী ঢাকা থেকে ১৭৫ কিলোমিটার দূরে বিভাগীয় শহর সিলেটের শ্রীমঙ্গলের অবস্থান। সেখানকার ৩২ বছর বয়সী যুবক সাইফুল ইসলাম প্রথম সাত স্তরের চা তৈরি করেন। চায়ের উৎপাদন অঞ্চলেই তাঁর জন্ম। নতুন কিছু করার অনুপ্রেরণা থেকেই সাত রঙের এ চা তিনি তৈরি করেন। সাইফুল ইসলাম ‘আরব নিউজ’কে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে দেখছি আমাদের এলাকার উৎপন্ন চা সারা দেশে যায়, যায় বিদেশেও।’ পড়ালেখা শেষ করে কী করবেন, তা নিয়ে বেশ চিন্তায় ছিলেন সাইফুল ইসলাম। ভবিষ্যতের জন্য পেশা হিসেবে কী বেছে নেবেন, কী করবেন, তা ঠিক করতে পারছিলেন না। চায়ের এলাকার লোক হিসেবে চায়েই খুঁজে নিলেন নিজের পথচলা। তিনি বলছিলেন, ‘ভালো স্বাদের সঙ্গে এক কাপ ভালো চায়ের জন্য আবেগ দিন দিন বেড়ে চলছিল। বিভিন্ন ধরনের চায়ের ওপর নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাই। শেষমেশ আমি লটারির মতো করে আমার স্বপ্নকে সত্য পরিণত করি। আমি তৈরি করে ফেলি এক কাপে সাত রঙা চা।’

শ্রীমঙ্গলের জন্য সাত স্তরের চা চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল। এর আগে ২০০৬ সালে রমেশ রাম গৌর পাঁচ স্তরের চা বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেন। এরপর দোকান খুলে চায়ের পসরা সাজিয়ে বসেন রমেশ রাম। জনপ্রিয়তা পায় ৫ স্তরের চা। রাম গৌরের বিভিন্ন রঙের চা দেখে অনুপ্রেরণা পান সাইফুল। এরপরই রাম গৌরের প্রতিবেশী সাইফুল বানান সাত স্তরের চা। শ্রীমঙ্গলে দোকান খোলেন সাইফুলও। ঢাকা বা দেশের অন্য এলাকা থেকে পর্যটকেরা সিলেট অঞ্চলে গেলেই এসব চা খান। আর অনেকেই মনে করেন সিলেটে গিয়ে এসব চা না খেলে যেন সফর অপূর্ণ রয়ে যাবে।

চাহিদা বাড়তে থাকায় রাজধানী ঢাকায়ও দোকান খোলেন সাইফুল। ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলা বাজারে সাত স্তরের চা মেলে। তালতলায় সাইফুলের দোকানের চা চা-প্রেমীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। রাজধানীর আনাচ-কানাচ থেকে অনেকেই আসনে চা খেতে। চা-প্রেমীরা আনন্দ নিয়ে সাত স্তরের চা খান। এ জন্য পকেট থেকে খসে যায় ৮০-৮৫ টাকা।

সাইফুলের দোকানে চা খেতে আসা ঢাকার বাসিন্দা শ্যামলী ইসলাম সুভার্থী ‘আরব নিউজ’কে বলেন, ‘এক কাপে আলাদা আলাদা সাত স্তরের চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা আসলে অন্য রকম। আমি আসলে এ রকম আগে কখনো কিছু খাইনি।’ তিনি বলছিলেন, ‘আমি অনেকবার এ চায়ের কথা শুনেছি। কিন্তু আসা হয়ে ওঠেনি। অবশেষে আমি এ চায়ের রোমাঞ্চকর স্বাদ পেলাম। আমি সত্যিই বেশ মজা পেলাম।’

আরিফুর রহমান চা-প্রেমী। তিনি ‘আরব নিউজ’কে বলেন, এই চা আমাকে অনন্য স্বাদের দুনিয়ায় নিয়ে নেয়। সুযোগ মিললেই বন্ধুদের সঙ্গে এখানে চা খেতে চলে আসেন বলেও জানালেন আরিফুর রহমান।

সাত রঙের চায়ের স্বাদে মাতোয়ারা অনেকেই। ছবি: এএনআই
সাত রঙের চায়ের স্বাদে মাতোয়ারা অনেকেই। ছবি: এএনআই

মেন্যু ও তৈরির প্রক্রিয়া জানান না সাইফুল
সাইফুল ইসলাম ও তাঁর কারিগরেরা কীভাবে সাত স্তরের এই চা বানান, তা নিয়ে মানুষের অনেক আগ্রহ। তবে উপায় নেই। কারণ তিনি এর রেসিপি কারও সঙ্গে শেয়ার করেন না। দোকানের এক কোণে কিছুটা আড়ালে সাত স্তরের চা বানানো হয়। এরপরই ক্রেতাদের টেবিলে ও হাতে পৌঁছে যায় সেই বিখ্যাত সাত স্তরের চা।

‘আমি চা বানাতে অনেক কিছু ব্যবহার করি—কালো চা, সবুজ চা, কফি, দুধ, কমলা এবং স্ট্রবেরি ব্যবহার করি।’ ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় নিজের স্টলে কাজ করার সময় সাইফুল ইসলাম ‘আরব নিউজ’কে বলছিলেন এ কথা। কিন্তু চা বানানোর প্রক্রিয়াটি তিনি বললেন না। তাঁর ভাষায়, চা বানানোর পদ্ধতিটি ‘বাণিজ্যিক গোপনীয়তার’ ব্যাপার।

নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সাত স্তরের চা খাওয়ার পর বলেন, ‘চায়ে যা ব্যবহার করা হয় তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। ’

সাইফুল ইসলাম নতুন ব্র্যান্ডের এই সাত স্তরের চায়ের দোকান দিয়ে পরিবার চালান। দুই মেয়েসহ চারজনের সংসারে বেশ সচ্ছল তিনি। প্রতি মাসে তিনি ৬০০ ডলার আয় করেন। ৮৫ টাকা প্রতি ডলার ধরলে টাকায় ৫১ হাজার।

সাইফুল ইসলামের চায়ের চাহিদা বাড়ছে দিনকে দিন। দেশে ও বিদেশে চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাইফুল তাঁর ব্যবসা প্রসারের পরিকল্পনা করছেন। ঢাকার পাশের দুই জেলা নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে দুটি নতুন আউটলেট খুলতে চান তিনি। এ বছরের শেষে এসব আউটলেট খুলতে চান বাংলাদেশে এক কাপে সাত রঙের চা বানানো সাইফুল।

অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরাতে থাকেন সাইফুল ইসলামের এক বন্ধু। তিনি সেখানে ‘রেইনবো টি’র একটি দোকান খুলতে চান। সাইফুল বলছেন, ‘আমি আশা করি আমার সাত রঙের চা প্রত্যেক মহাদেশের মানুষের মনে জায়গা করে নিক।’