বিপর্যয় কাটানোর পথ ঠিক করতে পারেনি বিএনপি

>
  • নির্বাচনের সময় দলের নেতৃত্বের ঘাটতি প্রকাশ পেয়েছে
  • নির্বাচনের পর নেতাদের মধ্যে ঝিমানো ভাব দেখা দিয়েছে
  • নেতৃত্বের পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে আনতে চাচ্ছেন কেউ
  • করণীয় নির্ধারণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কিছুটা দ্বিধা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় বিপর্যয়ের পর উত্তরণের পথ কী হবে, তা এখনো ঠিক করতে পারেনি বিএনপি। দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া প্রায় এক বছর ধরে কারাবন্দী। এ অবস্থায় পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে যাবে, নাকি আপাতত চুপচাপ থেকে দল গোছানোর কাজ করা হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি দলটি।

বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার মতে, ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দলের নেতৃত্বের ঘাটতি প্রকাশ পেয়েছে। নির্বাচনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে কিছুটা ঝিমানো ভাব দেখা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ এ পরিস্থিতিতে নেতৃত্বের পরিবর্তনের বিষয়টি সামনে আনতে চাচ্ছেন।

এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দুই জ্যেষ্ঠ নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মওদুদ আহমদ ‘ব্যর্থ বলে পরিচিতদের’ সরে দাঁড়িয়ে তরুণদের নেতৃত্বে আনার যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা নিয়েও নানা আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। নেতাদের অনেকে বোঝার চেষ্টা করছেন, ‘ব্যর্থ’ হিসেবে কে বা কাদের বুঝিয়েছেন মওদুদ ও মোশাররফ।

এ বিষয়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কারা ব্যর্থ, সেটা তো দল পুনর্গঠিত হলে প্রক্রিয়াতেই বেরিয়ে আসবে।

মওদুদ আহমদ এ বিষয়ে নতুন করে কোনো কিছু বলতে চাননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা বলার বলে দিয়েছি। আর ব্যাখ্যা করতে চাই না। বলতে গেলেই নানা রকমের কথা উঠবে। এমনিতেই আমরা একটা দুরূহ সময়ের মধ্যে যাচ্ছি। যদি কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়, তখন দেখা যাবে।’

দলের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, খন্দকার মোশাররফ ও মওদুদ আহমদের এ বক্তব্যের দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের কারও কারও মধ্যে অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। তাঁরা বোঝার চেষ্টা করছেন, হঠাৎ দুই জ্যেষ্ঠ নেতা কেন একসুরে এমন কথা বললেন। এর আগে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এই দুই নেতা নির্বাচনে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে না পারায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতৃত্বের সমালোচনা করেন। এ জন্য দলের দায়িত্বশীল একজন নেতাকেও জড়ান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এর রেশ ধরে ঐক্যফ্রন্টের সর্বশেষ বৈঠকে যাননি স্টিয়ারিং কমিটিতে বিএনপির তিন সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সর্বশেষ মোশাররফ ও মওদুদের বক্তব্য নিয়ে নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে দলে। এ পরিস্থিতিতে দলের করণীয় নির্ধারণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কিছুটা দ্বিধা দেখা দিয়েছে।

অবশ্য দুই জ্যেষ্ঠ নেতার বক্তব্য নিয়ে গণমাধ্যমের খবরকে ‘জল্পনা’ বলে মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যখন কাজ থাকে না, তখন এসব হয় আরকি। এত বড় ভোট ডাকাতি হলো, তা নিয়ে কোনো কথা নেই। মিডিয়া আছে বিএনপিকে আরও কত দুর্বল করা যায়, বিএনপিকে কীভাবে ভাঙা যায়, তা নিয়ে। কিন্তু বিএনপিতে কোনো সমস্যা নেই।

৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ‘নজিরবিহীন জালিয়াতির’ ভোট বলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। এরপর ঘোষণা দিয়ে দলের নির্বাচিত সাংসদেরা শপথ গ্রহণ থেকেও বিরত আছেন। ৩০ জানুয়ারি নতুন সংসদের অধিবেশন শুরু হবে। ঘরোয়া বক্তৃতা-বিবৃতিতে বিএনপির নেতারা নির্বাচনের কড়া সমালোচনা করলেও এখন পর্যন্ত কোনো কর্মসূচিতে যাননি। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য ইতিমধ্যে দল পুনর্গঠনের কথা আলোচনায় এলেও কবে নাগাদ, কোন প্রক্রিয়ায় এই কার্যক্রম শুরু হবে, তা এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

মওদুদ আহমদ মনে করেন, এই মুহূর্তে বিএনপির প্রধান কাজ হবে দলের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করা। কারণ, বিএনপির হাজার হাজার নেতা-কর্মী এখনো জেলে। তাঁদের বের করতে হবে। অনেকে অসহায় ও পঙ্গু হয়ে গেছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দল করাতে হলে তাঁদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এরপর ঘুরে দাঁড়াতে হলে অবশ্যই দল পুনর্গঠন করতে হবে। তারপর অন্য কিছু চিন্তা করা যাবে।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র বলছে, নির্বাচনের পর এখন বিএনপির কাছে অগ্রাধিকার হচ্ছে কারাবন্দী দলীয় প্রধান খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা। তাঁর কারামুক্তির জন্য আইনি পন্থার পাশাপাশি সম্ভাব্য আর কী কী উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে, তা নিয়ে দলের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে কারামুক্তির জন্য কর্মসূচি ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক মহলে তৎপরতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন নীতিনির্ধারকেরা। তাঁরা মনে করছেন, সরকার শুরু থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বাধার সৃষ্টি করছে, যা এখনো অব্যাহত আছে।

তবে দলের একটি সূত্র বলছে, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বা ছাড় দিয়ে হলেও তারা খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করতে চান। এ ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণ থেকে বিরত থাকা বিএনপির সাংসদদের সংসদে পাঠানোর বিনিময়ে খালেদা জিয়ার কারামুক্তির কথা কেউ কেউ বলছেন। যদিও বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তের ওপর।

জানা গেছে, দলের নেতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকে একেবারে চুপচাপ না থেকে কর্মসূচি শুরু করার পরামর্শ দিচ্ছেন। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কেউ ৩০ জানুয়ারি একাদশ সংসদের অধিবেশন শুরুর দিন সাদামাটা হলেও একটা কর্মসূচির ঘোষণা দিতে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান সংকট তো বিএনপির একার ব্যাপার না। এ সমস্যা গোটা জাতির। এক দিনেই এর উত্তরণের পথ ঠিক হয়ে যাবে না। সময় লাগবে, বসতে হবে। আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।