হৃদয় ভরা আলো

‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার দিনে হৃদয় সরকারকে মা কোলে করে পরীক্ষার হলে নেওয়া ছবি তোলেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এম এ আল মামুন। ফেসবুকে ওই ছবি পোস্টের পরই ব্যাপক সাড়া পড়ে। সেই আল মামুনের সঙ্গে মা ও হৃদয় সরকারের ভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার দিনে হৃদয় সরকারকে মা কোলে করে পরীক্ষার হলে নেওয়া ছবি তোলেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এম এ আল মামুন। ফেসবুকে ওই ছবি পোস্টের পরই ব্যাপক সাড়া পড়ে। সেই আল মামুনের সঙ্গে মা ও হৃদয় সরকারের ভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

হৃদয় সরকারের ব্যস্ততার শেষ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ১৩ জানুয়ারি থেকে ক্লাস শুরু হয়েছে। বিভাগের ওরিয়েন্টেশন, সেমিনারসহ নানা কাজে ব্যস্ত। তবে একটি হুইল চেয়ার পাওয়ায় হৃদয়ের মায়ের দায়িত্ব কিছুটা কমেছে। হৃদয়কে কোলে করে ক্লাসে নিতে হচ্ছে না। হৃদয় একাই হুইল চেয়ারে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেন। হৃদয়ের হৃদয় ভরা এখন শিক্ষার আলো। এ আলো তাঁর ভবিষ্যতের শুভজ্যোতি।
কিন্তু মায়ের মন, ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় যদি কোনো অঘটন ঘটে। তাই ছেলের হুইল চেয়ারের পিছু পিছু মা এবং হৃদয়ের ছোট ভাই হাঁটতে থাকেন। কোনো কোনো দিন রিকশায় মা ও হৃদয় বসেন, আরেক রিকশায় ছোট ভাই হুইল চেয়ারটি নিয়ে বসে। হৃদয় ক্লাস করেন, মা আর ভাই বাইরে বসে থাকেন। কোনো কোনো দিন মায়ের ছুটি মেলে, বসে থাকতে হয় না, হৃদয়ের বন্ধুরাই হৃদয়কে বাসায় পৌঁছে দেন।
গত সোমবার সকালে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে কথা হয় হৃদয় ও তাঁর মা সীমা সরকারের সঙ্গে। এ সময় হৃদয়ের ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া অন্তর সরকারও ছিল।

মা–ভাই ও বন্ধুদের সঙ্গে হৃদয় সরকার। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সামনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
মা–ভাই ও বন্ধুদের সঙ্গে হৃদয় সরকার। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সামনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার দিন বিজয় একাত্তর হল থেকে পরীক্ষার হলে হৃদয়কে কোলে করে নিয়ে যান তাঁর মা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এম এ আল মামুন মা ও ছেলের এ ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে পোস্ট করেন। তারপর ছবিটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সাড়া পড়ে। তারপর তা ইতিহাস। এখন হৃদয় ও তাঁর মাকে দেখে অনেকেই একটু থমকে দাঁড়ান, তারপর পরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করেন।
জন্মের পর দুই মাস বয়স থেকে হৃদয়ের শারীরে বিভিন্ন জটিলতা ধরা পড়ে। হৃদয় একা হাঁটতে পারেন না। দুটো হাত বাঁকানো। তবে নিজেই লিখতে পারেন। নিজে লিখেই পরীক্ষা দেন। টয়লেটে যাওয়া থেকে শুরু করে সব কাজেই সহায়তা করেন মা, ভাই ও বাবা সমীরণ সরকার। বাবা নেত্রকোনায় একটি ইটভাটায় ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় হৃদয় সরকার বাংলা অংশে ৯ দশমিক ৩০, ইংরেজি অংশে ১৪ দশমিক ৪০ ও সাধারণ জ্ঞান অংশে ২৭ দশমিক ৯০ নম্বরসহ মোট ১২০ দশমিক ৯৬ নম্বর পেয়ে ৩ হাজার ৭৪০তম হন৷ প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তির আবেদন করেছিলেন হৃদয়৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালা অনুযায়ী শুধু দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিবন্ধী কোটা প্রযোজ্য ছিল৷ তাই হৃদয় সরকারের ভর্তি নিয়ে তৈরি হয়েছিল অনিশ্চয়তা৷
গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী কোটার বিধিমালায় সংস্কার এনে শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরও যুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান শারীরিক প্রতিবন্ধী হৃদয় সরকার৷
হৃদয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সীমা সরকার দুই ছেলেকে নিয়ে রাজধানীর লালবাগে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে সিট পেয়েছেন হৃদয়। তবে শারীরিক জটিলতার কারণেই তিনি সেখানে থাকতে পারছেন না। লালবাগ থেকে প্রায় আধা ঘণ্টা হেঁটে হৃদয়ের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন হৃদয়ের মা ও ছোট ভাই। কখনো শরীর খারাপ লাগলে বা অনেক যানজট থাকলে রিকশা নিতে হয়। তবে রিকশায় যাতায়াত করলে দিনেই লেগে যায় ২০০ টাকা। তাই পারতপক্ষে রিকশা নিতে চান না হৃদয়ের মা।

ক্লাস শুরু হয়েছে ১৩ জানুয়ারি থেকে। নিয়মিত ক্লাস শুরু করেছেন হৃদয় সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
ক্লাস শুরু হয়েছে ১৩ জানুয়ারি থেকে। নিয়মিত ক্লাস শুরু করেছেন হৃদয় সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া মা ও ছেলের ছবির কল্যাণে বিবিসির করা বিশ্বের ১০০ অনুপ্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন সীমা সরকার । বিবিসির তালিকায় ৮১তম স্থানে রয়েছেন সীমা সরকার। বিশ্বের ৬০টি দেশের ১৫ থেকে ৯৪ বছর বয়সী বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীদের নিয়ে এই তালিকা তৈরি করা হয়। গত বছরের নভেম্বর মাসেই এ তালিকার কথা জানা যায়।
হৃদয় ক্লাসে, আর সীমা সরকার ক্যাম্পাসে বসে কথা বলেন। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, এ কথা বলতে গিয়ে সীমা সরকারের চোখেমুখে হাসির ঝিলিক। জানালেন, ছেলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, এ স্বপ্ন এখন বাস্তব। স্কুল, কলেজে নেওয়ার পাশাপাশি দোতলা, তিনতলায় হৃদয়ের পরীক্ষার সিট পড়ত। সীমা সরকার কোলে করেই পরীক্ষার হলে ছেলেকে বসিয়ে দিয়ে আসতেন। বললেন, ‘আমার বিশ্বাস ছিল, ছেলেরে কোলে করে পরীক্ষার হলে দিয়া আসতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হইতে পারবে। তাই কোলে করে নিয়া যাই। তখন মামুন ছবি তোলে। তারপর তো যা যা হইছে তা সবাই জানে। আগে ছিল আমার দুই ছেলে, এখন মামুন যোগ হইছে, এখন আমার তিন ছেলে।’ সীমা সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে মামুন তখন হাসছিলেন।

হুইল চেয়ার পাওয়ায় ক্লাস করার ঝক্কিটা কমেছে হৃদয় সরকারের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
হুইল চেয়ার পাওয়ায় ক্লাস করার ঝক্কিটা কমেছে হৃদয় সরকারের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

সীমা সরকার জানালেন, ২০০০ সালে নেত্রকোনার মাতৃসদনে হৃদয়ের জন্মকালীন জটিলতা দেখা দেয়। অদক্ষ নার্সের হাতে টানাহ্যাঁচড়া করে জন্মের পর ওর অক্সিজেন দরকার ছিল, কিন্তু মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া অক্সিজেন দেওয়া হয়। জন্মের পর দ্বিতীয় মাসেই ধরা পড়ে জটিলতা। ময়মনসিংহের নামকরা শিশুবিশেষজ্ঞের কাছে নিলে তিনি সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন—হৃদয় কোনো দিন মা-বাবা ডাকতে পারবে না। হাঁটতে পারবে না। ‘হাবাগোবা’ হবে। তখন থেকেই সীমা সরকারের জেদ চাপে। ছেলেকে ঢাকা, কলকাতা যেখানে পেরেছেন, সেখানেই চিকিৎসা করিয়েছেন।
বাড়িতে হৃদয়ের শরীরের দুই পাশে বাঁশ বেঁধে হাঁটানোসহ নানান ব্যায়াম করান। নির্দিষ্ট সময়েই ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করান। প্রতি পরীক্ষায় শারীরিক জটিলতার তুলনায় ভালো ফলাফল করে হৃদয়।
সেই হৃদয় এখন এক দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে না পারলেই অস্থির হয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ও আনন্দে মেতে থাকে। দূর থেকে সীমা সরকার তা দেখেন আর তৃপ্তির হাসি হাসেন। এই ছেলেকে পড়িয়ে কী হবে? এমন কথাও শুনেছেন সীমা সরকার। তবে দমে যাননি। তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তাঁদের মা ও ছেলের সংগ্রামে যাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের সবার প্রতি। নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক মঈনউল ইসলামের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন, তিনি নিজ থেকেই হৃদয়ের জন্য অত্যাধুনিক একটি হুইল চেয়ার দিয়েছেন। এতে করে মা ও ছেলের সংগ্রাম অনেকটাই সহজ হয়েছে। আর হৃদয়ের বাবার প্রতিও জানালেন অনেক কৃতজ্ঞতা। কেননা, তিনি পাশে না থাকলে এ ছেলেকে নিয়ে এত দূর আসা সম্ভব হতো না।

হৃদয়কে কোলে করে ক্লাসে নিতে হচ্ছে না। হৃদয় একাই হুইল চেয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
হৃদয়কে কোলে করে ক্লাসে নিতে হচ্ছে না। হৃদয় একাই হুইল চেয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২২ জানুয়ারি। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

সীমা সরকার বলতে থাকেন, ‘হৃদয়কে কোলে নিলে কোনো ওজনই মনে হয় না। কোলে নিতে নিতে অভ্যাস হয়ে গেছে। দুই ছেলেকে মুখে তুলে খাইয়ে না দিলে খায় না। এখন মাঝেমধ্যে হৃদয় একা চলাচল করার বায়না ধরে। কিন্তু আমি, ওর বাবা, ভাই কেউ চিন্তাই করতে পারি না ওরে একা ছাড়ার কথা। ওর কিছু হলে আমার উপায় আছে? আমরা মা আর ছেলেতে দুই বন্ধু। একজন অন্যজনরে মনের কথা বলি।’
বাসাভাড়া, যাতায়াতসহ অনেক খরচ। হৃদয়ের পড়াশোনার পেছনেও খরচ আছে। সীমা সরকার অনেকটা বাধ্য হয়েই বললেন, ‘আমি সব সময় মানুষের সহায়তা পাইছি। ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন পূরণ হইছে। এখন ছেলের পড়াশোনার জন্য কেউ যদি একটা স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিতেন, একটু নিশ্চিন্ত হইতে পারতাম।’
ক্লাসে ঢোকার আগে হৃদয় মা ও পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। বিশেষ করে মায়ের কথা উল্লেখ করে বলেন,‘মায়ের জন্যই তো আজ আমি এ জায়গায়।’