ওই নারীর স্বামীকে আগেই পুলিশে দেন অভিযুক্ত জাকের

নোয়াখালীর কবিরহাটে মা ও সন্তানদের জিম্মি করে এক গৃহবধূকে (২৯) গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে যাঁর নাম এসেছে, তিনিই ওই নারীর স্বামীকে ভোটের আগে পুলিশে ধরিয়ে দেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আলোচিত এই ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি জাকের হোসেন ওরফে জহির কবিরহাটের ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। যদিও এখন স্থানীয় আওয়ামী লীগ দাবি করেছে, জাকের দলের কেউ নন।

আর গৃহবধূর স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রি (নির্মাণশ্রমিক)। এলাকায় বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে ২৩ ডিসেম্বর পুলিশ তাঁকে আটক করে একটি বিস্ফোরক মামলায় কারাগারে পাঠায়, যে মামলায় তিনি এজাহারভুক্ত আসামি নন। ‘অজ্ঞাতনামা আসামি’দের একজন হিসেবে তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এরপর গত শুক্রবার দিবাগত রাতে ঘরে ঢুকে তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করেন তিন দুর্বৃত্ত, যাঁদের একজন ওই জাকের হোসেন। এই ঘটনা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। পরদিন জাকের হোসেন গ্রেপ্তার হন। স্ত্রী ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিষয়টি আদালতে উল্লেখ করে আইনজীবীরা জামিন আবেদন করলে​ গত রোববার স্বামীর জামিন মঞ্জুর করেন আদালত।

কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ছুটে যান নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্ত্রীর কাছে। সোমবার বিকেলে সেখানে স্বামীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনিই জানান, তাঁকে সরকারি দলের স্থানীয় দুই নেতা পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন, যাঁদের একজন ওই জাকের হোসেন। আরেকজন মুরাদ।

জাকেরকে দলীয় কর্মী হিসেবে স্বীকার না করলেও মুরাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, তা নিশ্চিত করেছেন কবিরহাটের ধানসিঁড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল মান্নান। তবে নির্যাতিত নারীর স্বামীকে পুলিশ ধরে নেওয়ার সময় জাকের ও মুরাদ উপস্থিত ছিলেন কি না, তা তিনি জানেন না বলে জানান।

নির্যাতিত নারীর স্বামীর ভাষ্য

নির্যাতিত নারীর স্বামী প্রথম আলোকে বলেন, তিনি শ্রমজীবী মানুষ। রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালান। সক্রিয় রাজনীতি করেন না, তবে বিএনপি সমর্থন করেন। ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাত দুইটার দিকে থানা-পুলিশের কয়েকজন সদস্য তাঁর বাড়িতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দেন। তিনি পরিচয় জানতে চাইলে তাঁরা পুলিশ পরিচয় দিয়ে দরজা খুলতে বলেন। তিনি দরজা খুললে পুলিশ তাঁকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলা হয়, তাঁর বিরুদ্ধে পরোয়ানা আছে। কী পরোয়ানা দেখতে চাইলে পুলিশ বলে, থানায় গিয়ে দেখাবে।

ওই নারীর স্বামী বলেন, এরপর পুলিশ তাঁকে দ্রুত ঘর থেকে টেনে বাইরে নিয়ে যায়। বাইরে দেখেন, ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুরাদ দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে উদ্দেশ করে মুরাদ বলেন, ‘বিএনপি করস তো, কয় দিন জেল খেটে আয়।’ এরপর সামান্য এগোনোর পর দেখেন যুবলীগের জাকের হোসেন ওরফে জহির পুলিশের গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে।

স্বামী জানান, তিনি তখনো বুঝতে পারছিলেন না, তিনি কী অপরাধ করেছেন, কেন আটক করা হচ্ছে? পরে থানায় নিয়ে তাঁকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মারামারির ঘটনায় করা একটি বিস্ফোরক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে পুরোনো একটি মামলায়ও তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তবে সেটা কী মামলা, কে করেছে, বলতে পারেননি। কারাগারে থেকেই খবর পেয়েছেন জাকের হোসেনসহ কয়েকজন তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছেন।

নির্যাতিত নারীর স্বামী বলেন, কারও সঙ্গে তাঁর তেমন বিরোধ ছিল না। তবে বসতঘরে পল্লী বিদ্যুতের মিটার লাগানো নিয়ে জাকেরের সঙ্গে তাঁর একবার কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনার জের ধরে জাকের ও মুরাদ তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন বলে তাঁর সন্দেহ। কিন্তু যে দুটি মামলায় তাঁকে জড়ানো হয়েছে, সে ঘটনাগুলো কী ছিল, তা এখন পর্যন্ত জানেন না বলে দাবি করেন তিনি।

ওই নারীর স্বামীকে জড়ানো মূল মামলাটি গত ১১ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে কবিরহাট থানায় করা হয়। মামলার ঘটনাস্থল হিসেবে কবিরহাট বাজারের ১০০ গজ দক্ষিণে শাহীনুল আবেদীন ট্রেডার্সের সামনের রাস্তার ওপর উল্লেখ করা হয়। মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ৫৩ জন, এর মধ্যে ওই নারীর স্বামীর নাম নেই। আসামিরা সবাই স্থানীয় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও অনেকে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়।

মামলায় ঘটনার যে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে, ওই দিন ওই নারীর স্বামী নিজ এলাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাছে ছিলেন বলে জানান। আর তাঁর এলাকা থেকে ঘটনাস্থল প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে।

মামলার বাদী মো. সৌরভ উল্যাহ ওরফে শরীফ। এজাহারে তাঁর পরিচয় লেখা হয় আওয়ামী লীগের কর্মী। অবশ্য তিনি সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি কবিরহাট পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। ওই মামলায় তিনি এজাহারে আসামি হিসেবে কতজনের নাম উল্লেখ করেছেন, তা বলতে পারেননি। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বিএনপির কর্মীদের হামলায় তিনিও আহত হয়েছিলেন, তাই দলীয়ভাবে মামলাটি করা হয়েছে। এর বেশি কিছু তিনি বলতে রাজি নন।

সেদিন যা ঘটেছিল

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ১১ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা শুরু উপলক্ষে নোয়াখালী-৫ আসনের বিএনপির প্রার্থী মওদুদ আহমদের কবিরহাট উপজেলা সদরে পথসভা করার কথা ছিল। তাঁর আগমন উপলক্ষে সকালে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে দলীয় নেতা-কর্মীরা উপজেলা সদরে আসতে থাকলে কবিরহাট জিরো পয়েন্ট ও আশপাশের একাধিক স্থানে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় বিএনপির দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা। এ পরিস্থিতিতে মওদুদ আহমদ কবিরহাটে ঢুকতেই পারেননি।

উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কামরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ওই দিন আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর হামলা হয়নি। আওয়ামী লীগই বিএনপির ওপর হামলা করেছে। এতে তিনিসহ বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী আহত হন। কামরুল দাবি করেন, আওয়ামী লীগ থানায় যে মামলা করেছে, তা সম্পূর্ণ সাজানো, বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যে।

এই মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি না হওয়া সত্ত্বেও একজন শ্রমজীবী ব্যক্তিকে (নির্যাতিত নারীর স্বামী) কেন গ্রেপ্তার করা হলো, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কবিরহাট থানার ওসি মির্জা মোহাম্মদ হাছান সোমবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ওই ব্যক্তিকে পুলিশ একটি বিস্ফোরক মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করেছিল। তবে ওই মামলায় ঠিক কতজন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন, তা খোঁজ না নিয়ে জানানো সম্ভব নয় বলে জানান ওসি। তিনি দাবি করেন, গ্রেপ্তারের সময় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কাউকে পুলিশের সঙ্গে রাখার অভিযোগ ঠিক নয়।

তবে নির্যাতিত নারীর স্বামীর আইনজীবী রবিউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, আগে স্বামীকে পুলিশে ধরানো এবং পরে স্ত্রীকে ধর্ষণ—দুটি ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা হতে পারে। স্বামীকে যাঁরা পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের একজন এরই মধ্যে আদালতে এ ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযানের (সুপ্র) নোয়াখালী জেলা সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে আটক করে মামলায় জড়ানোর ঘটনা কেবল মানবাধিকারের লঙ্ঘনই নয়, এটা একটা পরিবারকে ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এসব বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত।