প্রতিবন্ধীদের দরকার একীভূত সেবা

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মো. গোলাম রব্বানী। পাশে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক শেখ হামিম হাসান। গতকাল প্রথম আলোর কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মো. গোলাম রব্বানী। পাশে জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক শেখ হামিম হাসান। গতকাল প্রথম আলোর কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রয়োজন একীভূত স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন সেবা। তাদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন পেশাজীবীদের মধ্যে সংযোগ নিবিড় হওয়া দরকার। প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা প্রয়োজন।

‘একীভূত স্বাস্থ্যসেবা ও পুনর্বাসনে পেশাজীবী এবং সংগঠনের ভূমিকা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে পুনর্বাসন সেবা বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন। প্রথম আলো আয়োজিত এই গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতা দেয় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যানিটি অ্যান্ড ইনক্লুশন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এই গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়।

গোলটেবিলের শুরুতে হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনালের সমন্বয়কারী মো. মাজেদুল হক ও প্রকল্প ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা পৃথক দুটি গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল ২০১৭ সালে কুড়িগ্রাম ও নরসিংদী জেলায় প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে জরিপ করে। ৬ হাজার ৫০০ মানুষের ওপর করা ওই জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কুড়িগ্রামে ৬০ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা এবং ৮৩ শতাংশ মানুষ পুনর্বাসন সেবা পায় না। নরসিংদী জেলায় এই হার যথাক্রমে ২৮ ও ৪৭ শতাংশ।

হ্যান্ডিক্যাপ ইন্টারন্যাশনাল ও জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন যৌথভাবে ‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন সেবাগুলির মধ্যে সমন্বয়’ শীর্ষক অন্য গবেষণাটি করে ২০১৮ সালে। এতে দেখা যায়, একজন ব্যক্তির স্বাস্থ্য সমস্যা শুরু হওয়ার পর থেকে পুনর্বাসন সেবা নেওয়া পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর লাগে। গবেষণার সুপারিশে বলা হয়েছে, পুনর্বাসন সেবা সম্পর্কে স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন পেশাজীবীদের মধ্যে শক্তিশালীরেফারেল (পরামর্শ বিনিময় ও রোগী স্থানান্তর) প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান মো. গোলাম রব্বানী বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ১০৩টি কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের সেবা দিচ্ছে। তবে সেবাদানের ক্ষেত্রে দেশে প্রশিক্ষিত জনবল ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ঘাটতি আছে।

পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য পুনর্বাসনকেন্দ্রের (সিআরপি) প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেরি এ টেইলর বলেন, প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষায়িত সেবা ও প্রশিক্ষিত জনবল দরকার। প্রশিক্ষিত জনবলের জন্য পাঁচ বছরের শিক্ষা কার্যক্রম রয়েছে। কিন্তু সরকার স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষিতদের কাজের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছে। তিনি জানান, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসায় ‘মিউজিক্যাল থেরাপি’ নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছে সিআরপি।

গোলটেবিল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানে আলোচকেরা বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল আইন–২০১৮ পাসের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তবে তাঁরা বলেন, আইনে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

সরকার প্রতিবন্ধীদের বিষয়ে আন্তরিক বলে বৈঠকে জানান জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের পরিচালক শেখ হামিম হাসান। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার বিষয়টি এখন আন্দোলনের রূপ নিয়েছে।

স্ট্রোক, দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণে যেসব ব্যক্তির শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গ সক্রিয়তা হারিয়েছে, তাদের সেবার দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন বাংলাদেশ অকুপেশনাল থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণ সেন। তিনি বলেন, দেশে মাত্র ২৬৮ জন অকুপেশনাল থেরাপিস্ট আছেন। তাঁদের বড় অংশ কাজ করেন সিআরপিতে ও কিছু স্কুলে। অনেকে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন।

মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়াতে, দীর্ঘ আয়ু অর্জনে ও জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে ফিজিওথেরাপির বড় ভূমিকা আছে বলে জানান ফিজিওথেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের অনেকেরই জানা নেই কোন রোগীর কখন ফিজিওথেরাপির দরকার। কোন প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপি সেবা পাওয়া যায় সেই তথ্য জনগণের কাছে সহজলভ্য করতে হবে।

কৃত্রিম হাত বা পায়ের মতো অঙ্গ সংযোজন জটিল ও ব্যয়বহুল বলে মন্তব্য করেন ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর প্রস্থেটিকস অ্যান্ড অর্থোটিকস বাংলাদেশের সহসভাপতি শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনায় হাত-পা হারানো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। অথচ দেশে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজনে পেশাজীবী আছেন মাত্র ৩৮ জন।

মনোবিজ্ঞান সমিতির যুগ্ম সচিব মো. কামাল উদ্দিন প্রতিটি স্কুলে মনোবিদ নিয়োগের সুপারিশ করেন।

ভাষা ও যোগাযোগের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন সোসাইটি অব স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্টস-এর সভাপতি ফিদা আল-সামস। তিনি অভিযোগ করেন, ভুয়া ও মানহীন কোর্সের সনদ নিয়ে অনেকে স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি পেশায় ঢুকে পড়ছে। পুনর্বাসন সেবায় চিকিৎসকদের জন্য একটি নির্দেশিকা সরকারের তৈরি করে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন ডিজঅ্যাবেলড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যান্ড রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক দেবেশ দাস।

জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক রাজীব হাসান বলেন, জনবলের তুলনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে রোগী বেশি। এই পার্থক্য দূর করতে হবে। পুনর্বাসন সেবা প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার প্রস্তাব করেন সিআরপির মিরপুর শাখার ক্লিনিক্যাল অকুপেশনাল থেরাপিস্ট এস এম ফারহান বিন হোসেন।