অ্যাসিড সন্ত্রাসে মাত্র ৯ ভাগ মামলায় সাজা

>
  • সাজা হয় মাত্র ৯ ভাগ মামলায়
  • ১৬ বছরে ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়
  • একজনেরও সাজা কার্যকর করা হয়নি

অ্যাসিড-সন্ত্রাসের মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় অধিকাংশ আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র ৯ শতাংশ মামলায় অভিযুক্তদের সাজা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অ্যাসিড-সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে আসায় এখন পুরোনো মামলাগুলোর প্রতি প্রশাসনের সক্রিয় নজরদারি নেই। অ্যাসিড মামলা তদারক করার জন্য গঠিত জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের তিন মাস পরপর বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও গত তিন বছরে একটি সভাও হয়নি। জেলা কমিটির বৈঠক প্রতি দুই মাসে একবার হওয়ার কথা, তা-ও নিয়মিত হচ্ছে না। ৩ বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এত অধিকসংখ্যক মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি পুলিশ অধিদপ্তরকে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেন। কিন্তু সেই প্রতিবেদনও পাওয়া যায়নি পুলিশের কাছ থেকে।

অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্য অনুযায়ী গত ১৯ বছরে প্রায় দেড় হাজার নারী ও শিশু অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। সাজা হয়েছে মাত্র ৩৪৩ জনের।

আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী অ্যাসিডের মামলায় গত ১৬ বছরে ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কারও সাজা কার্যকর করা হয়নি। অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ অনুযায়ী ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ করার কথা বলা আছে।

এসএফ অ্যাসিড-সন্ত্রাসের সব হিসাব ধরে ২০০০ সাল থেকে। আর সরকার হিসাব ধরে আইন হওয়ার পর, ২০০২ সাল থেকে। দুই পক্ষের হিসাবেই গত ১৬ বছরে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনায় সারা দেশে মামলা হয়েছে ২ হাজার ১৬৯ টি। অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি দাবি করে ৮৬৬টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে সাজা হয়েছে, এমন মামলার সংখ্যা মাত্র ১৯৯। খালাস পেয়ে গেছেন ১ হাজার ৯৫০ আসামি।

এএসএফের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ানোয় অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার নারীদের হতাশা বাড়ছে। দৃশ্যমান এমন একটি অপরাধের জন্য যদি কেউ শাস্তি না পায় বা আসামিরা পার পেয়ে যায়, তবে এ অপরাধ আবার করার সুযোগ খুঁজবে দুর্বৃত্তরা।

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার নবম শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা আক্তারের মাথা, মুখ ও শরীর অ্যাসিডে ঝলসে দিলে ২২ দিন মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যায় সে। ওই মামলায় এক আসামিকে ২০১৭ সালের ৫ জুলাই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি ছয় আসামিকে বেকসুর খালাস দেন আদালত। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওই আসামি এখনো পলাতক।

ফারজানার পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ভাই আনিস উদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বোন মারা গেছে। আসামির মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটা কার্যকর করা হলো না। আমরা কোনো বিচার পেলাম না।’

অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার ১০ নারী ও তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। বিচার না হওয়ায় তাঁরা হতাশ। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার সিলেটের মনিরা বেগমের মতে, শুধু টাকাই খরচ হয়, বিচার পাওয়া যায় না। একই রকম হতাশা জানালেন সারা শরীর ঝলসানো খুলনার সখিনা বেগমও। তিনি বলেন, ‘সাক্ষীর অভাবে মামলা খারিজ হয়ে গেছে। আসামিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকাশ্যে, আর আমি যন্ত্রণায় ভুগছি।’

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিগগির আমরা বৈঠক করব। আসলে সাক্ষীরা হাজির হয় না বলে বেশির ভাগ আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা চেষ্টা করব এমন কিছু উদ্যোগ নিতে যাতে আসামিরা সাজা পায়।’

অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে নিয়মিত কাজ করছে এএসএফ ও প্রথম আলো ট্রাস্ট। ১৯৯৯ সাল থেকে এ কাজ শুরু করে এএসএফ। আর ২০০০ সালে অ্যাসিড-সন্ত্রাস ভয়াবহ রূপ নিলে প্রথম আলোর কর্মীদের এক দিনের বেতন ৩২ হাজার টাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল। এই তহবিল থেকে ৪৫৬ জন নারী সহায়তা পেয়েছেন। এর মধ্যে ৩০২ জনকে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। অ্যাসিড-সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হংকংয়ের ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাব প্রথম আলোকে দ্য গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড অ্যাওয়ার্ড-২০১০ প্রদান করে।