নগরায়ণের সঙ্গে কলেবর বাড়ছে আবাসন শিল্পের

জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দেশের আবাসন খাত। এ খাতে দিন দিন কর্মসংস্থান বাড়ছে। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) আবাসন খাতের অবদানও ঊর্ধ্বগামী।

গত দু-তিন বছরে আবাসন ব্যবসায় কিছুটা শ্লথগতি দেখা গেছে। বেড়েছে নির্মাণসামগ্রীর দাম। এর সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যও। এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নেতৃস্থানীয়রা বলছেন, চলতি বছরটি এ ব্যবসার জন্য আবার এক অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে। তবে এ জন্য সরকারের সার্বিক সহায়তা চেয়েছেন তাঁরা।

নগর আবাসনের অর্ধেকের বেশি চাহিদা মেটায় বেসরকারি আবাসন খাত। তাই নগর পরিকল্পনাবিদেরা মনে করেন, নগর পরিবেশ উন্নত করতে এ খাতের অগ্রগতি প্রয়োজন। নগর-পরিকল্পনায় আবাসন শিল্পের প্রতিনিধিদের জোরদার অংশগ্রহণের পক্ষে তাঁরা।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের দাবি, বেসরকারি আবাসন খাতকে তাঁরা গুরুত্ব দেন। এ খাতকে উন্নত করতে তাঁরা সচেষ্ট।

নগরে বাড়ছে মানুষ, রাজধানীতেও বাড়ছে: জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ নগরবাসী ছিল। ২০১১ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৮ শতাংশ।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) তাদের ‘বাংলাদেশ আরবান ডায়নামিকস: রিসেন্ট ফাইন্ডিংস অ্যান্ড ট্রেন্ড অ্যানালাইসিস’ শীর্ষক গবেষণায় বলেছে, নেপালের ‘অস্বাভাবিক’ নগরায়ণ বাদ দিলে বাংলাদেশের নগরায়ণের হার এই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নগরীর মধ্যে ঢাকাও বাড়ছে সবচেয়ে বেশি হারে।

বিশ্বের ক্রমবর্ধমান মেগাসিটিগুলোর মধ্যে ঢাকা এখন অন্যতম। দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশের বেশির বসবাস রাজধানীতে। দেশের গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে এ নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার চার গুণ বেশি। জাতিসংঘের তৈরি ‘ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টাস: দ্য ২০১৪ রিভিসন’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা হবে বিশ্বের ষষ্ঠ জনবহুল নগরী। আর তখন লোকসংখ্যা হবে ২ কোটি ৭০ লাখ।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮০ সালে কলকাতার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ হয় ঢাকার জনসংখ্যা। আর ২০০৫ সালে কলকাতাকে ছাড়িয়ে যায় ঢাকা। ২০১৫ সালে কলকাতার জনসংখ্যার চেয়ে ৩০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে ঢাকায়। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের নগর জনসংখ্যার ৩১ শতাংশের বসবাস ছিল ঢাকায়। ২০১১ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশ।


আবাসন ব্যবসার কলেবর বাড়ছে: দ্রুত নগরায়ণের ফলে জমির ওপর চাপ বেড়েছে দিন দিন। এরই এক অনিবার্য ফসল আবাসন খাত। বাংলাদেশে আবাসন ব্যবসার বয়স এখন ৪০ পেরিয়ে গেছে। দেশের বেসরকারি আসান খাত মোট নগর আবাসনের অর্ধেকটা মেটায়। ১৯৯৬-৯৭ সাল থেকে আবাসন ব্যবসা বড় আকারে শুরু হয়। আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান রিয়াল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯১ সালে। সে সময় প্রতিষ্ঠানটির সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ১১। রিহ্যাবের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন এর সদস্যসংখ্যা ১১৯১।

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নগরায়ণে বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় ভূমিকা আছে। ঢাকায় জনসংখ্যার যে চাপ, সে তুলনায় হাইরাইজ ভবন কিন্তু কম। যদি অন্তত মুম্বাই বা সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করি। তারপরও এই আবাসন খাত বড় ভূমিকা পালন করছে।’ তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে মানুষের মধ্যে ভালো জায়গায় থাকার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে আবাসন ব্যবসার একটা সম্পর্ক আছে।

বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তরের চিত্র দেখলে এ ব্যবসার অগ্রগতির চিত্র উঠে আসে। শেলটেকের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে ঢাকায় মাত্র ১৬৪টি অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর হয়েছিল। পরের এক দশকে এই হার খুব এগোয়নি। ১৯৯৬ সালে ১ হাজার ৬টি অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তরিত হয়। এক দশক পরে এর পরিমাণ ছয় গুণ বেড়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে হস্তান্তর হওয়া অ্যাপার্টমেন্টের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৮০০।

রিহ্যাবের হিসাব অনুযায়ী, এখন ঢাকা নগরে বছরে ৩০ হাজার অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা আছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ এখন কম। চার থেকে পাঁচজনের পরিবারের মাঝারি আকারের অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদাই বেশি।

চাহিদা বেশি ১২০০ থেকে ১৩০০ বর্গফুটের: তাপস সরকার ও মৌলী সরকার দম্পতির দুই ছেলে। তাপস প্রকৌশলী, মৌলী ব্যাংকার। তাঁদের দুজনের বাবা-মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। দেড় দশক হয়ে গেল তাঁদের দাম্পত্য জীবনের। দুজনের ঢাকায় আসা প্রথম প্রজন্ম। উৎসবে বা পারিবারিক নানা আয়োজনে এখনো ঘরমুখী হন দুজনেই।
মৌলী বলছিলেন, ‘আমরা এখনো গ্রামের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আমাদের সন্তানদের পক্ষে হয়তো সেটা রাখা সম্ভব হবে না। এখন ওদের স্থায়ী ঠিকানা হবে ঢাকা।’ সন্তানদের একটি স্থায়ী ঠিকানা গড়ে দিতে চান তাপস-মৌলী। রাজধানীর কলাবাগানে একটি অ্যাপার্টমেন্টের জন্য আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত। কত বড় বাসা চাই? উত্তরে তাপস বলছিলেন, ‘আমাদের ঊর্ধ্বে ১৩০০ বর্গফুটের হলেই চলবে। যেমন দাম চাইছে, এর চেয়ে বড় কিনতেও পারব না। এর চেয়ে বড় অ্যাপার্টমেন্টের দরকারও নেই।’

এমন একক পরিবার দেশের নগরায়ণ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে বাড়ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে একান্নবর্তী পরিবার ভাঙছে। পরিবার হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী আর তাঁদের সন্তান মিলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় পরিবারের গড় আকার ৪ দশমিক ২। এসব পরিবারের মধ্যে আর্থিক সক্ষমতার নিরিখে যাঁরা মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত, তাঁদের কাঙ্ক্ষিত অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা ১২০০ থেকে ১৪০০ বর্গফুটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। দুই থেকে তিন কক্ষের বাসা হলেই তাঁদের চলে যায়।

আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান শেলটেকের গবেষণা অনুযায়ী, ১২০০ থেকে ১৩০০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। প্রতিষ্ঠানটির উপমহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মুহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের ১২০০ থেকে ১৫০০ বর্গফুট আয়তনের অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদা মোট চাহিদার প্রায় ৫০ শতাংশ।’ ১৪০০ থেকে ৩ হাজার বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্টের চাহিদাও আছে, তবে তা খুব কম।’

কারা কিনছেন অ্যাপার্টমেন্ট: আড়াই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে আর্থিক উন্নতি হয়েছে। দেশের জিডিপির আকার বেড়েছে। দু-এক বছরের মন্দা অবস্থার কথা বাদ দিলে তৈরি পোশাক খাত, রেমিট্যান্স ক্রমেই বাড়ছে। এর সঙ্গে বাড়ছে অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির সংখ্যা। বেসরকারি আবাসন ব্যবসায়ীদের একাধিক প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, এলাকার সুবিধাকেই অ্যাপার্টমেন্ট কেনার ক্ষেত্রে বড় অগ্রাধিকার দেন ক্রেতারা। নিজের অফিস বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি, সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি বাসা কিনতে চান ক্রেতারা। এর সঙ্গে তাঁদের চাই বসবাসের পরিবেশ। আবাসন ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ব্যাংকার—তাঁরাই অ্যাপার্টমেন্টের বড় ক্রেতা। আবাসন ব্যবসায়ীদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারী পরিবারগুলোর মধ্যে ৫১ শতাংশ পরিবারের প্রধানের আয়ের প্রধান উৎস ব্যবসা। এরপর আছে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংকারদের মতো খাতের ব্যক্তিরা।

আবাসন প্রতিষ্ঠান শেলটেকের সূত্র জানায়, তাদের ক্রেতাদের মধ্যে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, ব্যাংকারই বেশি। শেলটেক মিরপুরে বীথিকা নামে একটি প্রকল্পের ৩০ শতাংশ ক্রেতাই চিকিৎসক। বাকি ক্রেতাদের মধ্যে ২০ শতাংশ ব্যবসায়ী, প্রকৌশলী ২০ শতাংশ।

অর্থনীতিতে অবদান বাড়ছে আবাসন খাতের: বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে স্থিরমূল্যে নির্মাণ খাত থেকে ৫২ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন হয়েছে। এটি জিডিপির ৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০১৩ সালে জিডিপির আকার ছিল ৭ লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে নির্মাণ খাতের সম্প্রসারণ হয়েছে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে দেশের মোট উৎপাদনে খাতটি প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার মূল্য সংযোজন করেছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ খাতের অবদান ছিল ৪৮ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির প্রায় ৬ দশমিক ৯০ শতাংশের সমান।

২০০৯-১০ অর্থবছরে এ খাতের অবদান ছিল ৩৮ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা। সে অর্থবছরে জিডিপিতে এ খাতের অবদান ছিল ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এরপর ক্রমেই এ খাতের মূল্য সংযোজন যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে জিডিপিতে অবদানও স্ফীত হয়েছে। এ ছাড়া ২০১১-১২ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ৪১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকার মূল্য সংযোজন করেছে এ খাত।

২০১৪-১৫ সালে ভিত্তিমূল্যে নির্মাণ খাতের অবদান ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর হার ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ। চলতি বাজারমূল্যে জিডিপিতে নির্মাণ খাতের অবদান গত এক দশকে চার গুণের বেশি বেড়েছে।

আবাসন ব্যবসায়ীরা জিডিপিতে আবাসন খাতের অবদান আরও বেশি বলে মনে করেন। তাঁদের দাবি, মোট দেশীয় উৎপাদনে (জিডিপি) এ খাতের অবদান এখন ১২ থেকে ১৫ শতাংশ।
এর কারণ প্রসঙ্গে তৌফিক এম সেরাজ বলেন, জিডিপিতে অবদানের ক্ষেত্রে আবাসন খাত দুভাবে অবদান রাখে, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক। পরিসংখ্যানে আনুষ্ঠানিক খাতের অবদান যেভাবে হিসাব করা হয়, অনানুষ্ঠানিক খাতের হিসাব সেভাবে আসে না।

এর উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আবাসন খাতের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পরিবহনের জন্য যে পরিবহনশ্রমিক কাজ করেন, তা জিডিপিতে সরাসরি অবদান রাখে, কিন্তু এটা রিয়েল এস্টেটের অবদান হিসেবে জিডিপিতে প্রতিফলন দেখতে পাওয়া কঠিন। অন্যদিকে, আবাসন খাতের সঙ্গে প্রায় ২৭০টি সংযোগশিল্প জড়িত, যেগুলো সরাসরি জিডিপিতে অবদান রাখে। প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক এই খাতে শ্রম দিচ্ছেন। এসব সংযোগশিল্প এবং শ্রমিকের অবদান বিবেচনায় নিয়ে জিডিপিতে আবাসন খাতের মোট অবদান হিসাব করতে হবে।

দুর্মূল্য হচ্ছে জমি: রাজধানীর জমির উচ্চমূল্য আবাসন খাতের একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ক্রেতাদের সুলভ মূল্যে অ্যাপার্টমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি প্রতিবন্ধকতাও। গত দেড় দশকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে জমির দাম। রাজধানীর কিছু এলাকায় জমির দাম আকাশচুম্বী। যেমন বারিধারায় কাঠাপ্রতি জমির এখন দাম ৬ কোটি টাকা। ভাড়া হোক বা কেনা হোক—উভয় ক্ষেত্রেই ক্রেতা বা ভোক্তাকে অধিক অর্থ দিতে হচ্ছে।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, নগরে জমি ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আবাসনের প্রয়োজনীয়তা ঠিক এখানেই। তবে ঢাকায় যে হারে জমির দাম বাড়ছে, সেটা অস্বাভাবিক। এ জন্য ভালো আবাসন পেতেও ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ। যেটা সুষ্ঠু নগরায়ণের জন্য প্রতিবন্ধকতা বটে।

শেলটেকের এক গবেষণা অনুযায়ী, রাজধানীর বাড়িধারায় আট বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে। গুলশানে জমির দাম বেড়েছে আড়াই গুণ। ২০১০ সালে বারিধারায় কাঠাপ্রতি জমির গড়পড়তা মূল্য ছিল ৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এর দাম দাঁড়ায় ৬ কোটি টাকা। গুলশানে এক কাঠা জমির দাম ২০১০ সালে ছিল ২ কোটি টাকা। ২০১৮–তে এসে এর দাম দাঁড়ায় ৫ কোটি টাকা।

রাজধানীর অপেক্ষাকৃত কম চাহিদার এলাকাগুলোতেও জমির দাম দুই থেকে তিন গুণ বেড়েছে গত দেড় দশকে। ২০০০ সালে বাসাবোতে এক কাঠা জমির গড়পড়তা দাম ছিল ৮ লাখ টাকা। এখন এর দাম হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। বাড্ডায় ২০১০ সালে কাঠাপ্রতি জমির দাম ছিল ৩০ লাখ টাকা। এখন এর দাম ৫০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

নির্মাণসামগ্রীর দাম ঊর্ধ্বমুখী: রড, সিমেন্ট, ইটসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর মূল্য দিন দিন বাড়ছে।এর ফলে নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে। বাড়ছে অ্যাপার্টমেন্টের দাম। গত বছরের মার্চ মাসে রিহ্যাব নেতারা নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথা জানান। রিহ্যাবের প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে মারাত্মক সমস্যায় পড়বে আবাসন বা গৃহনির্মাণ খাত। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ইত্যাদির দাম বাড়ায় চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নির্মাণশিল্প খাতের ওপরেও। এসব কারণে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন।’

আবাসন ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের পর থেকে আবাসন খাতের নির্মাণসামগ্রীর দাম দিন দিন বাড়ছে। ২০০০ সালে প্রতি কিউবিক ফুট বালুর দাম ছিল ১০ টাকা। ২০০৫ সালে এর দাম হয় ২২ টাকা। প্রতি ব্যাগ সিমেন্টের দাম ২০০০ সালে ছিল ১৯৩ টাকা। পাঁচ বছর পর এর দাম হয় ২৮৩ টাকা। রডের দাম ২০০৫ সালের পর থেকে ক্রমেই বেড়েছে। টনপ্রতি ৬০ গ্রেডের রডের দাম ৩৯ হাজার টাকা থেকে ২০১০ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ৫৪ হাজার ৪০০ টাকা। চলতি বছর রডের দাম ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে আবাসন খাত: আবাসন খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকারের রাজস্ব আয়, কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ নানাবিধ কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। আবাসন শিল্পকে ঘিরে রং, রড, সিমেন্ট, টাইলসসহ ২৬৯টি সংযোগ শিল্প গড়ে উঠেছে। সংযোগ শিল্পগুলো আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো সংযোগ শিল্প রপ্তানিও করছে। সংযোগ শিল্পগুলোতে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের দেশজ শিল্প।

বিবিএস শ্রমশক্তি জরিপ-২০১৬ অনুযায়ী, ১৯৯৫ সালে নির্মাণ খাতের শ্রমিকের সংখ্যা ছিল দেশের মোট শ্রমিকের ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ । এক দশক পরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ। ২০১৬-১৭ সালে নির্মাণ খাতে শ্রমিক মোট শ্রমিকের প্রায় ৬ শতাংশ।

বাংলাদেশের আবাসন শিল্প শুধু আবাসনই সরবরাহ করছে না, একই সঙ্গে ৩৫ হাজার উচ্চতর ডিগ্রিধারী প্রকৌশলী, ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, স্থপতি ও উচ্চতর ব্যবস্থাপকদের কর্মসংস্থানের সঙ্গে ৩৫ লাখ শ্রমিক জড়িত। এই শ্রমশক্তির ওপর নির্ভরশীল ২ কোটি মানুষ। এই সেক্টরে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে। শিক্ষিত বেকার সমস্যা সমাধানে বিশাল অবদান রেখে আসছেন রিহ্যাবের সদস্যরা। ওপরের সংখ্যা দেখেই বুঝতে পারছেন কতগুলো জনশক্তি রিয়েল এস্টেট শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়বে।

গৃহঋণের উচ্চহার: সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি) গ্রাহকদের সব জায়গায় বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট কিনতে ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ ঘোষণা করে গত বছর। বাড়ি নির্মাণ ও ফ্ল্যাট ক্রয়ে সংস্থাটি এর আগে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় ফ্ল্যাট ঋণ ছাড়া সব ধরনের ঋণে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ সুদহারে ঋণ দিত। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকাসহ সব বিভাগীয় ও জেলা সদরে ঋণ দিত ১০ শতাংশ সুদে। উভয় ক্ষেত্রেই এখন অভিন্ন সুদের হারে ঋণ দিচ্ছে এই সংস্থা।

তবে আবাসন ব্যবসায়ীরা মনে করেন, এই সুদের হার এখনো অনেক বেশি। তাঁরা দীর্ঘ মেয়াদে এই হার ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি করেন। আবাসন প্রতিষ্ঠান শেলটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক এম সেরাজ বলেন, গৃহঋণে সুদের হার এখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১০ শতাংশের বেশি। প্রাথমিকভাবে এই সুদের হার কমিয়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশে নিয়ে আসা প্রয়োজন। দীর্ঘ মেয়াদে এই সুদের হার ৪ থেকে ৫ শতাংশে আনা প্রয়োজন।

গৃহঋণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার দাবি সার্বিক অর্থনীতির ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে শঙ্কায় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, সুদের হার কমলে হয়তো বেশিসংখ্যক ক্রেতা অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে আগ্রহী হবেন। তবে এর প্রভাবও তো বিবেচনায় নিতে হবে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের। তবে তারা যদি বিষয়টি বিবেচনা করে, তবে এর প্রভাবও নিশ্চয়ই ভাববে।

অ্যাপার্টমেন্টের দাম বাড়ছে: গত দেড় দশকের মধ্যে রাজধানীতে অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি। আবাসন ব্যবসায়ীরা এর জন্য জমির উচ্চমূল্য এবং নির্মাণসামগ্রীসহ অন্যান্য আবাসন উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছেন।

শেলটেকের গবেষণা অনুযায়ী, রাজধানীর ধানমন্ডিতে ১৯৯০ সালে অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গফুটের গড়পড়তা দাম ছিল ২ হাজার ১৫০ টাকা। দেড় দশক পর ২০০৫ সাল নাগাদ এর দাম হয় ৩ হাজার ৩০০ টাকা। গত বছর বর্গফুটপ্রতি দাম ছিল ১৫ হাজার টাকা। উচ্চ আয়ের মানুষের এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশানেও এই দাম কিছুটা একই রকম ছিল।

রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বারিধারায় অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এখন এ অঞ্চলে প্রতি বর্গফুটের সবচেয়ে বেশি অর্থ গুনতে হয়। এই এলাকায় গড়পড়তা প্রতি বর্গফুটে পড়ে ২২ হাজার টাকা। অথচ ২০০৫ সালে এখানে প্রতি বর্গফুটে খরচ গুনতে হতো ৪ হাজার টাকার মতো।

রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ঢাকায় জমির দাম বেশি। ঢাকায় ফ্ল্যাট নির্মাণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয়ের মধ্যে আবাসন ব্যবসায়ীরা ফ্ল্যাট দিতে পারেন না। সারা দেশে রড, সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম এক। শুধু জমির দামে হেরফের। ফ্ল্যাটের ক্রেতারা সবাই ঢাকামুখী।


রেজিস্ট্রেশন ফির বোঝা: অ্যাপার্টমেন্টের উচ্চমূল্যের পাশাপাশি হস্তান্তর ও রেজিস্ট্রেশন ব্যয় ক্রেতার জন্য একটি বড় বোঝা। অ্যাপার্টমেন্টের খরচ বাদ দিয়ে সব মিলিয়ে মোট সাড়ে ৯ শতাংশ খরচ চাপে ক্রেতার ঘাড়ে। এর মধ্যে আছে গেইন ট্যাক্স ২ শতাংশ, স্ট্যাম্প ৩ শতাংশ, সরকারের খাতে রেজিস্ট্রেশন ফি ৩ শতাংশ, সিটি করপোরেশনের জন্য ২ শতাংশ আর সবশেষ সাবরেজিস্ট্রারের জন্য দশমিক ৫ শতাংশ। এসব আইনি পরিকাঠামোয় টাকা ঢালার পর ক্রেতার ওপর বাড়তি বোঝা মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট। প্রতি বর্গফুটের জন্য সেখানে গুনতে হয় দেড় শতাংশ ভ্যাট।

আবাসন ব্যবসায়ীরা গৃহঋণের সুদের হার কমানোর দাবি করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।

রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি তৌফিক এম সেরাজ বলেন, এখন জমি রেজিস্ট্রেশনের জন্য আয়কর, ভ্যাট এবং অন্যান্য শুল্ক মিলে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ খরচ পড়ে। এই অতিরিক্ত খরচ অনেক ক্ষেত্রেই ক্রেতাদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা হিসেবে দেখা দেয়। এই খরচ কমিয়ে একটি সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসতে হবে।

নতুন বছরে ভালো ব্যবসার আশা: গত বছরের অক্টোবরে একটি অনুষ্ঠানে আবাসন খাতের কয়েকজন কর্তাব্যক্তির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই বছরের ব্যবসার হাল নিয়ে মনঃক্ষুণ্ন। সামনে নির্বাচন, পরিস্থিতি কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কাও আছে তাদের মধ্যে। এক ব্যবসায়ী বললেন, ‘নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে আবাসন খাত।’

নির্বাচনের পর অবশ্য এখন আশাবাদী হয়ে উঠেছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রতিটি নির্বাচনের আগেই বাজার কিছুটা স্থবির হয়। অতীতেও হয়ে এসেছে। মানুষের মনে আশঙ্কা থাকে, নির্বাচনের কারণে কোনো বিশৃঙ্খলা হতে পারে। এবারের নির্বাচনে সে ধরনের বিশৃঙ্খলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। আশা করা যায়, মানুষের মধ্যে আবাসন খাত নিয়ে আস্থা ফিরে আসবে।

আবাসন ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, চলতি বছর ব্যবসায় ৯ শতাংশের বেশি হবে আগের বছরের তুলনায়। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সহজ শর্তে যে ঋণ সুবিধা সরকার দিয়েছে, এতে আবাসন খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

গত বছর সরকারের চালু করা সুবিধার আওতায় মাত্র ৫ শতাংশ সরল সুদে সরকারি চাকরিজীবীরা ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গৃহনির্মাণ ঋণ নিতে পারবেন। আপাতত রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন (বিএইচবিএফসি) থেকে এই ঋণ নেওয়া যাবে।

আবাসন খাতের সঙ্গে জড়িত এক প্রকৌশলী বলেন, অনেক ক্রেতা ২০১৮ সালে সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতার কথা ভেবে তাঁদের বিনিয়োগ বন্ধ রাখেন। তবে সেই পরিস্থিতি এখন কেটে গেছে।