আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ার মধ্যেও বন্দুকযুদ্ধ

>

• নতুন বছরে এখন পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ১৪ জন
• আত্মসমর্পণ বিষয়ে অধিদপ্তর–র‍্যাব–বিজিবি জানে না
• একাধিক বাহিনী যে যার মতো অভিযান চালাচ্ছে
• আত্মসমর্পণ নিয়ে দ্বিমত, সমন্বয়হীনতার প্রভাব
• টেকনাফজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক ও অস্থিরতা

ছোট ছেলে বন্দুকযুদ্ধে নিহত, বড়টিকে বুধবার পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার ভোরে বন্দুকযুদ্ধে দুজন নিহত হওয়ার খবর পেয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তাঁদের সত্তরোর্ধ্ব বাবা। সেখানে নেই নিশ্চিত হয়ে এখন সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির পেছনে ঘুরছেন।

কথাগুলো টেকনাফ ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি মো. খলিলুর রহমানের। তিন ছেলের বাবা খলিল মাদক–বিরোধী অভিযান নিয়ে টেকনাফে কী হচ্ছে বুঝতে পারছেন না। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বললেন, ছোট ছেলে ইউসুফ জালালকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে গত ১৩ ডিসেম্বর। বড় ছেলে হামযা লালকে খুঁজতে মেজ ছেলে মোহাম্মদ জালালকে কক্সবাজার পাঠিয়েছেন। শুনেছেন সেখানে সবাইকে আত্মসমর্পণের জন্য রাখা হয়েছে। কিন্তু তাঁর প্রশ্ন হলো, আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়ার কথা বলে আবার বন্দুকযুদ্ধ কেন?

মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে সন্দেহভাজন মাদক ব্যবসায়ীর বাবা যেমন কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না, মাঠপর্যায়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের কাজে যুক্ত বাহিনীগুলোর ধারণাও পরিষ্কার নয়। গত সোমবার থেকে বুধবার পর্যন্ত পুলিশ, র‍্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে তা-ই বলেছেন। বাহিনীগুলোর সব কটিই মাঠে আছে, তবে কাজ করছে যে যার মতো। কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই।

প্রসঙ্গত, পুলিশের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া চলার মধ্যেই এ বছরের শুরু থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে কক্সবাজারে ১৪ জন নিহত হন। তাঁদের ১৩ জনই টেকনাফের। ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে চারজন, র‍্যাবের সঙ্গে চারজন, বিজিবির সঙ্গে দুজন, পুলিশ ও বিজিবির যৌথ অভিযানে একজন ও পুলিশের ভাষ্যমতে মাদক ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুজন নিহত হন। গতকালও বাহারছড়ায় র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুজন নিহত হয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে ৫০ হাজার ইয়াবা ও দেশীয় পিস্তল উদ্ধার হয়েছে।

পুলিশ সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদিকে সঙ্গে নিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের যে উদ্যোগ নিয়েছে, সে সম্পর্কে টেকনাফ থানা-পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে জানে না। র‍্যাব প্রক্রিয়াটির সঙ্গে একমত নয় বলে বাহিনীটির দায়িত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আত্মসমর্পণের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তালিকা করা হচ্ছে। আমাদের কাছে তালিকা আসুক। তারপরই আমরা এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে জানাব।’ 

অভিযানে যে যার মতো

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১ হাজার ১৫১ জন মাদক বিক্রেতার তালিকায় ৯১২ জনই টেকনাফের বাসিন্দা। এখান থেকে শতাধিক ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করছেন বলে জানাচ্ছে পুলিশের সূত্রগুলো। পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, টেকনাফে এ মুহূর্তে সবচেয়ে জোরদার অভিযান চলছে পুলিশের। পুলিশ ইয়াবার গ্রাম বলে পরিচিত মৌলভীপাড়া ও নাজিরপাড়ায় গিয়ে ইয়াবা বিক্রেতাদের সুরম্য অট্টালিকা ভেঙে দিয়েছে, পুলিশের ভয়ে কমপক্ষে ৫০টি বাড়িতে কোনো পুরুষ থাকছেন না। চলতি মাসে তাঁরা ৬৬ জনকে গ্রেপ্তার, ৪৯ হাজার ১০০ পিস ইয়াবা, ১০টি এলজিসহ ৩৮টি গুলি উদ্ধার করেছে।

তবে গতকালও শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় থাকা সাবেক সাংসদ আবদুর রহমান বদির ভাই মৌলভী মুজিবুর রহমানকে টেকনাফে গাড়ি চালিয়ে ঘুরতে দেখা গেছে। উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ ও তাঁর চার (একজন গুম) ছেলের নাম তালিকায় থাকলেও তাঁরা আছেন বহাল তবিয়তে। জাফর আহমেদ আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আবার মনোনয়ন নিতে ঢাকায় অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছে তাঁর কাছের একটি সূত্র।

এদিকে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটি কীভাবে হবে, সে সম্পর্কে পুলিশ নিশ্চিত করতে পারছে না। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, মাদক বিক্রেতাদের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে কোনো সরকারি ঘোষণা বা চিঠি তিনি পাননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ গডফাদারদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করিয়ে তাঁদের আদালতে পাঠানো হবে। এতে করে তাঁরা বলতে পারবেন, পুলিশ বড় মাদক বিক্রেতাদের ধরে ফেলেছে। আবার র‍্যাবও টেকনাফের কোনো গডফাদারকে ধরতে পারেনি। পৌর কাউন্সিলর একরামুলকে বড় কারবারি হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা ছিল। পরে সেটা ভেস্তে গেছে।

অন্যদিকে র‍্যাবের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জলদস্যু আর ইয়াবা কারবারিরা এক নয়। জলদস্যুরা অস্ত্র সমর্পণ করেছেন। ইয়াবা কারবারিরা কি জমা দেবেন? ২০০ গ্রাম ইয়াবা পাওয়া গেলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে নতুন আইনে। আত্মসমর্পণ করার সময় তাঁরা কতটুকু জমা দেবেন? না দিলে বাকিটা কী হবে? তাঁদের ধনসম্পদের কী হবে? ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, যাঁরা আত্মসমর্পণ করছেন তাঁরা ইতিমধ্যেই ‘ভিআইপি’, ‘সিআইপি’ এবং জনপ্রতিনিধি হয়ে গেছেন। অভিযানের কারণে এলাকায় ফিরতে পারছিলেন না। আত্মসমর্পণের পর তাঁরা সনদ নিয়ে এলাকায় ফিরে আসবেন। এতে সাময়িকভাবে ইয়াবা নিয়ন্ত্রণ হলেও পরে আবার ইয়াবার কারবার শুরুর আশঙ্কা থাকবে।

টেকনাফ-২ বিজিবির ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক শরীফুল ইসলাম জোমাদ্দার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে জানেন না। তবে তাঁদের বিশেষ অভিযান চলছে। সীমান্তে টহল বেড়েছে। চলতি মাসেও তাঁরা দুই লাখের ওপর ইয়াবা ধরেছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কক্সবাজার জেলার সহকারী পরিচালক সৌমেন মণ্ডল জানান, তাঁরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং ওপরে রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন।

সমন্বয়হীনতার অভিযোগ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি অপরাধ নিয়ে কাজ করার দায়িত্ব প্রধানত পুলিশের। তবে সব বাহিনীই চাইছে, ইয়াবা নির্মূল হোক এবং তাদের সবাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায়। আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া কিংবা মাঠপর্যায়ে সমন্বয় না হওয়ার কোনো অভিযোগ যদি থাকে, সেটা তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে পারে। 

সমন্বয়হীনতার প্রভাব মাঠে

টেকনাফজুড়ে এখন আতঙ্ক ও অস্থিরতা। স্থানীয় বাসিন্দারা চান, ইয়াবা পাচার বন্ধ হোক। একই সঙ্গে চান রক্তপাত না হোক। অন্তত ইয়াবা বন্ধে সবার প্রতি সমান আচরণ করা হোক।

গতকাল বৃহস্পতিবার মৌলভীপাড়ায় এক দোকানির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি জানান, মুড়াপাড়ার ইউসুফ জালাল তাঁদের পাড়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন। এলাকার সবচেয়ে বিলাসবহুল ভবনটি এখন পরিত্যক্ত, দেয়াল ও মোটা কলামগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মৌলভীপাড়ার অবস্থান মিয়ানমার সীমান্তের কাছেই। এখানে বিজিবির টহল থাকে। যেদিন ইয়াবা আসে সেদিন রাত আটটার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করেন বিজিবির কোনো কোনো সদস্য, যেন নিরাপদে ইয়াবার চালান আসতে পারে। তাঁরা যত দিন না আন্তরিক হবেন, তত দিন পর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা আসা বন্ধ হবে না।