রাসায়নিকের বিকল্প কেঁচো সার

কেঁচো সার উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন এক নারী। বুধবার দুপুরে শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি ইউনিয়নের চিনাশুকানিয়া গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
কেঁচো সার উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন এক নারী। বুধবার দুপুরে শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ি ইউনিয়নের চিনাশুকানিয়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো
>

• নারীরাও প্রশিক্ষণ নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন করে অর্থ রোজগার করছেন
• তাঁদের দেখাদেখি অন্য নারীরাও উদ্যোগী হচ্ছেন
• রাসায়নিক সারের বদলে ব্যবহার হচ্ছে কেঁচো সার

সবজি চাষে ব্যবহারে সফলতা এবং উৎপাদনপ্রক্রিয়া সহজ হওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট)। গাজীপুরের শ্রীপুরে কৃষকেরা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে এখন কেঁচো সারের ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছেন। নারীরাও প্রশিক্ষণ নিয়ে কেঁচো সার উৎপাদন করে অর্থ রোজগার করছেন। তাঁদের দেখাদেখি অন্য নারীরাও উদ্যোগী হচ্ছেন।

উপজেলার সর্বদক্ষিণের রাজাবাড়ি ইউনিয়নের নিভৃত এক গ্রাম চিনাশুকানিয়া। কৃষির প্রতি প্রেম আছে এমন কৃষকে ভরপুর গ্রামটি। বুধবার দুপুরে রাজাবাড়ি বাজার থেকে চিনাশুকানিয়া যেতে সড়কের দুই পাশের চিত্র দেখে কৃষির প্রতি মানুষের মায়া চোখে পড়ে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, লাউ, পুঁইশাক, টমেটোসহ বাহারি শস্য ছড়িয়ে আছে সবখানে। এদিন চিনাশুকানিয়া পৌঁছে কথা হয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। সবজিখেতের সবুজের জৌলুশের পেছনের গল্পটা জানা হলো তাঁদের কাছ থেকে।

এই গ্রামের কৃষক সুমন শেখ জানান, এক বছর ধরে তিনি তাঁর শস্যখেতে রাসায়নিক সার ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছেন। বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক কেঁচো সার ব্যবহার করছেন। তাঁর মতো এই এলাকায় এমন সার ব্যবহার করা কৃষকের সংখ্যা ৪০-৫০ জন। আরেক কৃষক মজিবুর রহমান বলেন, এই সারের ব্যবহারে সবজিখেতে শস্য উৎপাদন বেড়ে যায়। তা ছাড়া এটি রাসায়নিক সারের বিকল্প হওয়ায় স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সবজি উৎপাদিত হয়।

এক বছর ধরে কেঁচো সার উৎপাদন করছেন চিনাশুকানিয়া গ্রামের মাকসুদা বেগম। তিনি কেঁচো সার উৎপাদন সম্পর্কে ধারণা দিয়ে বলেন, প্রথমে তিনি কৃষি অফিস থেকে কেঁচো আনেন। পরে স্থানীয় খাল-বিল থেকে আধাপচা কচুরিপানা এনে ছোট ছোট টুকরা করেন। এর সঙ্গে আধাপচা কলাগাছ টুকরা করে কেটে মেশানো হয়। সঙ্গে গোবর মিশিয়ে বস্তায় ভরে ১২ থেকে ১৫ দিন রেখে দেন। এরপর এই উপাদানগুলো সিমেন্টের পাত্রে রেখে সেখানে কেঁচো ছাড়া হয়। ২০-২২ দিনের মধ্যে উপাদানগুলো কেঁচো সারে পরিণত করে। এই সারই হলো কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট।

আরেক উদ্যোক্তা মোশরিফা খাতুন বলেন, এই সার উৎপাদন করে তিনি তাঁর পরিবারের খরচের একটি অংশ রোজগার করতে চান। এই উদ্দেশ্যেই সার উৎপাদনের উদ্যোগ নেন তিনি। পাশের অন্য একজনকে দেখে তিনি উদ্যোগী হন। বর্তমানে তাঁর উদ্যোগ দেখে অনেকেই এই উৎপাদনে আসতে চাইছেন। কেঁচো সার উৎপাদনে যুক্ত আছেন এই গ্রামের লাভলী, ফাতেমা খাতুনসহ আরও অনেক নারী।

কৃষি অফিসের তথ্যমতে, উর্বর মাটিতে ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকার কথা। এতে মাটিতে পানির ধারণক্ষমতা ও বায়ু চলাচলের সুযোগ বাড়ে। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ এলাকায় মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ মাত্র ১ শতাংশ। তাই মাটিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ালে মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা বাড়বে। ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার মাটিকে নরম করে এবং পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন অণুজীবের বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে ক্রমেই ভূমির উর্বরতা কমে যেতে থাকে। ফলে এখন থেকেই মাটিতে কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার বাড়াতে হবে।

উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আইরিন সুলতানা বলেন, সবজি উৎপাদনে এই এলাকার কৃষকেরা কয়েক বছর ধরেই কেঁচো সার উৎপাদন ও ব্যবহার করছেন। বর্তমানে এখানে কেঁচো সার উৎপাদন করছেন ৩৫ জন। তাঁরা এগুলো স্থানীয় কৃষিপণ্যের দোকানে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছেন। একই সঙ্গে জমিতে রাসায়নিকের ব্যবহারও কমছে। প্রতি মাসেই কেঁচো সারের উৎপাদনকারীর সংখ্যা বাড়ছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এই এলাকায় সার উৎপাদনকারীরা কেঁচো উৎপাদন করে বিক্রি করতে পারবেন। প্রতি কেজি কেঁচোর বাজারমূল্য দুই থেকে তিন হাজার টাকা।

শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ এস এম মূয়ীদুল হাসান বলেন, ‘জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্পের (এনএটিপি-২) আওতায় উপজেলার রাজাবাড়ি ইউনিয়নে পরীক্ষামূলকভাবে এই সার উৎপাদন করা হচ্ছে। এ ছাড়া আরও দু-একটি ইউনিয়নে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই উৎপাদন করছেন। বর্তমানে যাঁরা কেঁচো সার উৎপাদন করছেন, তাঁদের সফলতায় আমরা নতুন উৎপাদনকারী পাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘সারের উৎপাদনের জন্য আমরা আপাতত কেঁচোসহ সব উপকরণ বিনা মূল্যে কৃষকদের দিচ্ছি। বড় পরিসরে কেউ উদ্যোগ নিলেও আমরা তাঁকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।’