১৮৬ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা

>
  • বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ফিরোজ কবির
  • কবির রূপালী ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা
  • দুটি সমিতির মাধ্যমে টাকা হাতিয়েছেন কবির
  • কবির মূলত অবৈধ ব্যাংকিং করেছেন
  • গ্রাহকদের উচ্চ সুদের লোভ দেখিয়েছেন
  • দীর্ঘ সময় সরকারি দপ্তরগুলো ব্যবস্থা নেয়নি
  • জামিন পাওয়ার পর থেকে পলাতক কবির

সরকারের সাবেক সচিব, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, পুলিশের সাবেক ও বর্তমান ডিআইজি পদের কর্মকর্তা, সাবেক সাংসদ, চিকিৎসক, মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, শিল্পী, প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত লাভের ফাঁদে পা দিয়ে প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা খুইয়েছেন।

সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধন করে দুটি সমিতির মাধ্যমে যিনি এই বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, তাঁর নাম খান মো. ফিরোজ কবির। তিনি রূপালী ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা। চার্টার্ড ক্রেডিট কো-অপারেটিভ লিমিটেড ও লয়েডস কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে দুই প্রতিষ্ঠান খুলে তিনি মূলত অবৈধ ব্যাংকিং করেছেন। উচ্চ সুদের লোভ দেখিয়ে তিনি চার্টার্ড ক্রেডিট কো-অপারেটিভ লিমিটেডের মাধ্যমে ১৩৪ কোটি ৭০ লাখ এবং লয়েডস কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের মাধ্যমে ৫২ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছেন। কথিত আমানত হিসেবে এই টাকা নেওয়ার পর শুরুর দিকে কয়েক মাস নিয়মিত সুদ দিয়ে পরে আস্তে আস্তে বন্ধ করে দেন। দীর্ঘ সময়ে প্রতিষ্ঠান দুটির অবৈধ ব্যাংকিংয়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

সংগীতশিল্পী নাশিদ কামালের পরিবার লয়েডস কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে প্রায় ১৪ কোটি টাকা আমানত রেখেছিলেন। টাকাগুলো তাঁর বাবা সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের বাড়ি বিক্রির টাকা। নাশিদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবা তাঁর কষ্টের টাকা রেখে গিয়েছিলেন। এই টাকা আমাদের ভাইবোনদের পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই এ টাকা তুলতে পারছি না। ফিরোজকেও পাওয়া যাচ্ছে না।’

সাবেক সচিব ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক মিয়া তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ৭০ লাখ টাকার কথিত এফডিআর (স্থায়ী আমানত) করেছেন চার্টার্ড ক্রেডিট কো-অপারেটিভ নামের সমবায় সমিতিতে। তাঁকে মাসে ১২ শতাংশ হারে সুদ বা লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু এখন সমিতির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খান মো. ফিরোজ কবিরের কোনো খোঁজ মিলছে না। এই টাকার উৎস জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এগুলো তাঁর চাকরিতে অবসর-সুবিধার টাকা; সঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের কিছু টাকাও ছিল।

সম্প্রতি মতিঝিলে প্রতিষ্ঠান দুটির কার্যালয়ে গিয়ে তা তালাবদ্ধ দেখা যায়। আমানতকারীদের কয়েকজন দাবি করেন, এ কার্যালয় থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এই দুই সমিতির মূল ব্যবস্থাপনা কমিটির ১২ জন কর্মকর্তা যেন দেশ ত্যাগ করতে না পারেন, সে জন্য সমবায় অধিদপ্তর থেকে ২০ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, তারা মাত্র ছয়জনের পাসপোর্টের বিস্তারিত পেয়েছে। বাকিদের তথ্য পায়নি। ফলে তাঁরা দেশে আছেন, নাকি বিদেশে চলে গেছেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এই সমিতিতে টাকা রেখেছেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমানও। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কত বিনিয়োগ করেছি তা বড় কথা নয়। টাকাটা ফেরত পাওয়াটাই বড় কথা। টাকা ফেরত পেতে সমবায় অধিদপ্তর এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছি। কিন্তু কোনো সমাধান পাচ্ছি না।’

মোহাম্মদপুরের মিনা আক্তারের স্বামী সেনাবাহিনীতে কাজ করতেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রতি মাসে ১০-১২ হাজার টাকা পাওয়ার আশায় সঞ্চয়ের পুরো টাকা এই সমিতিতে স্থায়ী আমানত হিসেবে জমা রাখেন। অশ্রুসজল মিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমন হবে জানলে টাকা মাটির নিচে রেখে দিতাম। কাউকে না জানিয়ে এখানে বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন কার কাছে যাব, কী করব, বুঝতে পারছি না।’

নিরুপায় মিনা আক্তার খুব সহজে তাঁর এই প্রতারিত হওয়ার কথা বললেও অন্য যাঁরা টাকা খুইয়েছেন, তাঁদের অনেকে লজ্জায় নাম প্রকাশ করে কথাও বলতে চান না। কেউ কেউ আবার ভয়ও পাচ্ছেন। সাড়ে চার হাজার লোকের কাছ থেকে আমানত নিয়েছে এই দুই সমিতি।

এই দুই সমিতির প্রতারিত সদস্যদের অভিযোগ, সমবায় অধিদপ্তরের কোনো তদারকি নেই বলে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের সমিতির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সমবায় দপ্তরের কিছু কর্মকর্তারও যোগসাজশ থাকে বলে সন্দেহ করছেন তাঁরা। সমবায় দপ্তরে গিয়ে কোনো সুরাহা না পাওয়ায় তাঁদের মধ্যে এমন ধারণা পোক্ত হচ্ছে।

সমবায় সমিতি আইন অনুযায়ী, আমানতের ৭৫ শতাংশ অর্থ আমানতকারীকে ঋণ হিসেবে দেওয়া যাবে। সদস্য নয় এমন ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়া যাবে না। কিন্তু সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা আইন ভেঙে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ঋণ দিয়েছেন। সমিতির কাগজপত্রে দেখা যাচ্ছে, চার্টার্ড ক্রেডিট কো-অপারেটিভ লিমিটেড ১৪০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে। এই ঋণের বড় অংশ নিয়েছেন ফিরোজ কবির, তাঁর মেয়ে রেজুয়ানা কবির, ভাই নওরোজ কবির, ভাইয়ের স্ত্রী সাবিরা বানু, বোনের স্বামী কাজী মফিজুল ইসলাম, মামাতো ভাই সৈয়দ আনোয়ারুল নাফিস, বন্ধু আজিজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী শেলী রহমানসহ বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজন।

এখন টাকা উদ্ধারের জন্য সক্রিয় সদস্যদের মধ্যে ১২ জনকে নিয়ে একটি কমিটি করেছেন আমানতকারীরা। এই কমিটির সভাপতি ফিরোজ কবিরের মামা সেনাবাহিনীর সাবেক কর্নেল সৈয়দ আনোয়ারুল জাকির। কমিটির ১২ সদস্যের মধ্যে ৬ জন ফিরোজ কবিরের স্বজন ও পক্ষের লোক। বাকি ৬ জন সাধারণ আমানতকারীদের পক্ষের। তাঁদের পক্ষে চিকিৎসক তানজিয়া খান কমিটির সহসভাপতি।
সমিতির কয়েকজন সদস্য প্রথম আলোকে জানান, টাকা না পেয়ে তাঁদের কয়েকজন ফিরোজ কবিরের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন। ১৮টি মামলা হয়েছে। তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। তারপর জামিনে বেরিয়ে আত্মগোপন করেন।

জামিন পাওয়ার বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, ফিরোজ কবিরের মামা কর্নেল আনোয়ারুল জাকির সমবায় অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়ে তাঁর জামিনের ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়েছেন। গত বছরের ৪ আগস্ট পাঠানো চিঠিতে ফিরোজ কবিরের বিরুদ্ধে চলা ১৮টি মামলা স্থগিত করার অনুরোধ করা হয়। বলা হয়, মামলা স্থগিত হলে সমিতি চালু করে কিছু টাকা জোগাড় করা সম্ভব হবে। এই মুহূর্তে ১০ কোটি টাকা পাওয়ার বিষয়ে আদালতের আদেশ আছে। আরও ২৯ কোটি টাকা পাওয়ার পথ আছে। এ ছাড়া ফিরোজ কবিরের ১১ একর জমি আছে, তা বিক্রি করেও টাকার ব্যবস্থা করা যাবে। তিনি দ্রুত জামিন পেলে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

কিন্তু জামিন পাওয়ার পর থেকে পলাতক আছেন ফিরোজ কবির। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ফিরোজ কবিরের মামা আনোয়ারুল জাকিরকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘আমি এখন অনেক ব্যস্ত আছি। এ বিষয়ে কোনো কিছু বলতে পারব না।’ ১০ মিনিট পর তিনি নিজেই প্রতিবেদকের মুঠোফোনে ফোন করে আগামী শনিবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তখন ফিরোজ কবিরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফিরোজ কবির জেলে আছেন।’ তিনি তো জামিনে বেরিয়ে গেছেন—এই তথ্য জানালে জাকির বলেন, ‘ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, জামিনে আছেন।’ তাঁর সঙ্গে ফিরোজ কবিরের যোগাযোগ আছে কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তাঁর সাহায্য ছাড়া যাঁদের ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তা তোলা বা সদস্যদের আমানত ওঠানো সম্ভব নয়।’ এত টাকা নিয়ে ফিরোজ কবির কী করেছেন জানতে চাইলে কর্নেল জাকির বলেন, ‘আমার কাছে আপাতত কোনো কাগজপত্র নেই। তাই বলতে পারব না। তবে পরিচিত বন্ধুবান্ধব, স্বজন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছেন বলে জানি।’

তানজিয়া খান প্রথম আলোকে জানান, তাঁর বাবা বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের সাবেক সাংসদ তাহেরুল ইসলাম খান এই সমিতিতে ৩ কোটি টাকার ওপরে টাকা জমা রেখেছিলেন। তিনি এই টাকা তাঁর মায়ের জন্য রেখে গিয়েছিলেন। তানজিয়া বলেন, ‘এভাবে সমিতির অনেক সদস্য মারা গেছেন। তাঁরা টাকার জন্য হাহাকার করে গেছেন। প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বারের স্ত্রী শাহীন জব্বার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর আমরা চাপ দিয়ে কিছু টাকা তুলে দিয়েছি।’ তানজিয়া সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছেও এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন বলে জানান। মন্ত্রী তাঁদের মামলা করার পরামর্শ দেন।

জানতে চাইলে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক মো. আব্দুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, সমবায় সমিতির নিয়মকানুন না মেনে অনেকেই স্থায়ী আমানত বা এফডিআর জমা রেখেছেন। এখানে আমানতের পরিমাণ অনেক, যাঁরা রেখেছেন তাঁরাও শিক্ষিত ব্যক্তি। তাঁরা কেন এসব সমিতিতে এত টাকা আমানত রাখলেন? তিনি বলেন, ‘ফিরোজ কবির যে দুটি সমিতির আমানত ফেরত দিচ্ছেন না, সেই সমিতির বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। মামলা দেওয়া হয়েছে। আমরা ফিরোজ কবিরকে জেলেও পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু জেলে থাকলে কোনো সদস্যই টাকা ফেরত পাবেন না। আমরা দেখছি কী করা যায়।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশি লাভের আশায় কেউ কেউ ব্যাংক ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখছেন। এসব টাকা ফেরত না পেলে কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই। ব্যাংক ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যাংকিং করা যে বেআইনি, তা আমরা বারবার সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে আসছি।’

সার্বিক বিষয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব কামাল উদ্দিন তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ মন্ত্রণালয়ে নতুন দায়িত্বে এসেছি। যদি সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি থাকে, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর আমানতকারীরা কীভাবে টাকা ফেরত পেতে পারেন, তাও আমরা খতিয়ে দেখব।’