দুটি ছবি একটি ব্যথা

জোড়া খুনের খুনি বখতিয়ার আলমের ‘মুক্তহস্ত’ বনাম নির্দোষ জাহালমের হাতকড়া।
জোড়া খুনের খুনি বখতিয়ার আলমের ‘মুক্তহস্ত’ বনাম নির্দোষ জাহালমের হাতকড়া।

জোড়া খুন করলেও মানীর মান যাওয়ার কথা নয়। তাই তিনি মুক্তহস্তে পুলিশের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে হেঁটে যান। আর নির্দোষ জেনেও শ্রমিক জাহালমের হাত বাঁধা থাকে হাতকড়ায়। মানীর মান কি আর জোড়া খুন বা ব্যাংক ডাকাতি করলে যেতে পারে?

ছবি কথা বলে। আজকের প্রথম আলোর পৃষ্ঠায় পাশাপাশি দুটি ছবি। জোড়া খুনের আসামি বখতিয়ার আলমকে আদালতের বারান্দায় মুক্তহস্তে চলতে দেখা যায়। পুলিশের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ তাঁর দুটি হাত মুক্ত। আর জাহালম নামের শ্রমিকটার কপাল এমনই, বিনা দোষে তিন বছর জেল খাটলেন, এই তিন বছর তাঁকে হাতকড়া পরিয়েই আদালতে আনা-নেওয়া করা হলো। কিন্তু গরিবের আবার সম্মান কি? বখতিয়ার আলমের সাজার দিনেও জাহালমকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে আনা হয়। যদিও মামলার বাদী দুদক বলেছে জাহালম নির্দোষ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তদন্ত করে জানিয়েছে জাহালম ভুলের শিকার। তবু দুদিন পর যার জামিন হবে সেই লোকটি এতই বিপজ্জনক যে তাকে হাতকড়া না পরালেই নয়।

বখতিয়ার আলম সাবেক এমপির পুত্র। এহেন মানীর মান জোড়া খুন করলেও যাবার কথা নয়। যায়ওনি। তাই হাতের মতো মুখও তাঁর স্বাধীন। যাবজ্জীবন সাজা পাওয়ার পর সাংবাদিকেরা ছবি তুলতে গেলে তিনি বলেন, ‘পোজ তো দিলাম, আর কত।’ একই কথা কি বলতে পারতেন ৩৩টি ভুয়া মামলার আসামি জাহালম? সেই মুখ কি তাঁর আছে? তিনি তো ‘মফিজ; মুখ খুলতে যাঁদের মানা। কিন্তু ছবি তারপরও কথা বলে।

ছবির বাইরেও কথা আছে। জেলবাস কষ্টের। বখতিয়ার আলমকে তাই ভিআইপি অসুখের অজুহাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভিআইপি কেবিনে থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। আরা জাহালমকে কারাগার থেকে আদালত আর আদালত থেকে কারাগারে হাতকড়া পরিয়ে ঘোরানো হয়। জেলের মধ্যেও খরচ লাগে, তা জোটাতে মানুষের কাপড় ধোয়া, ফাইফরমাশ খাটার কাজও তাঁকে করতে হয়েছে। আগেকার দিনে চিঠপত্রে লেখা থাকত, ‘শ্রেণি অনুযায়ী বড়দের সালাম ও শ্রদ্ধা, সমবয়সীদের ভালোবাসা এবং ছোটদের আদর দেবেন’। আসামিদের বেলায়ও দেখা যাচ্ছে তাই। বড়লোক শ্রেণির আসামিরা পান জামাই আদর আর গরিবেরা পান তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য। ভিআইপিরা মানী লোক, তাঁদের মান রাখাও তো কর্তৃপক্ষের কর্তব্য।

মদ্যপ অবস্থায় বখতিয়ারের পিস্তলের গুলিতে মরে যাওয়ারাও কেউকেটা কিছু নন। মামুলি ধরনের মানুষ। একজন রিকশা চালাতেন আরেকজন চালাতেন সিএনজি। গরিব মানুষ তো কতভাবেই মরে। কুমিল্লায় ইটভাটার তেরো শ্রমিক ট্রাকচাপায় নিমেষে মারা গেল; তাতে কী হয়েছে? মজুরি নিয়ে প্রতারণার প্রতিবাদ করায় ৫ হাজার গার্মেন্টস শ্রমিকের চাকরি গেল, জেল বা নির্যাতনের শিকার হলেন অনেকে, গুলিতে মারা গেল এক তরুণ; তাতে কী এসে গেল। বরং বখতিয়ার এবং তাঁর মতো আর যাঁরা মানী লোক আছেন, যাঁদের নাম নেওয়া বারণ, আসুন আমরা তাঁদের মঙ্গল কামনা করি। বখতিয়ার মদের কারণে গুলি করেছেন। তাই শাস্তি যা পাওয়ার তা মদের বোতলেরই প্রাপ্য। সম্ভবত এ কারণেই মৃত্যুদণ্ডের বদলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আমরা যেমন মূল দায়ীদের ছেড়ে ঘাতক ট্রাক-বাসের নিন্দা করি, তেমন করে এখন ওই ঘাতক বোতলকে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে মৃত্যুদণ্ড দিলেই হয়।

খুলনার সাংবাদিক হেদায়েত হোসেনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটকের পর হাতকড়া পরিয়ে আদালতে উপস্থাপনের দৃশ্য। ছবি: ডেইলি স্টার
খুলনার সাংবাদিক হেদায়েত হোসেনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটকের পর হাতকড়া পরিয়ে আদালতে উপস্থাপনের দৃশ্য। ছবি: ডেইলি স্টার

সাংবাদিকেরাও বর্তমানে জাহালমের শ্রেণির লোক। গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলে ‘গরমিলে'র খবর করায় খুলনায় দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছিল৷ সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করে শ্রেণি মোতাবেক হাতে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে চালান করে। সেই ছবিটাও সাংবাদিকদের তুলতে হয়। পরে ব্যাপক সাড়া পড়ে গেলে তাঁদের জামিন হয়। জাহালমের বিষয়ে প্রথম আলোর সংবাদ সাড়া জাগালে নিরপরাধ মানুষটিকে মুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে উচ্চ আদালত। এদিকে জোড়া খুনের দায়ে যাবজ্জীবনের পর নিহত সিএনজি অটোরিকশা চালক ইয়াকুবের স্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘এই রায়ে আমি অখুশি। আমি জানি এই আসামি একদিন বের হয়ে আসবে’। আশা করি বখতিয়ারের মতো আসামিদের সাজা মওকুফ করিয়ে মুক্ত করার ব্যবস্থা চালু থাকবে।

এবং আমরা এও আশা করি, বখতিয়ার আলমকে কোনো একদিন কোনো এক রাষ্ট্রপতি তাঁর স্বীয় মহানুভবতার গুণে ক্ষমা করে দেবেন। আমরা তো সেই ‘আশা’র বাতাসেই দিনযাপন করছি।

ফারুক ওয়াসিফ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক