খুন-ধর্ষণের আসামিদের সঙ্গে ওসির সভা

>

* ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের’ নিয়ে উঠান বৈঠক
* মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে বৈঠকটি ডাকা হয়
* বৈঠকে ছিলেন খুন, ধর্ষণ মামলার আসামি
* পুলিশের ওপর হামলা মামলার আসামি

পুলিশ সেবা সপ্তাহে ‘চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের’ নিয়ে উঠান বৈঠক করেছেন চট্টগ্রাম নগরের খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ নাসির উদ্দিন। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজারের ইস্পাহানি মোড়ে এই বৈঠক হয়। এতে চিহ্নিত সন্ত্রাসী ছাড়াও মাদক ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত আরও অনেকে অংশ নেন বলে অভিযোগ ওঠে।

বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ এফ কবির আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সখ্য নিয়েও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছিল। মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও ইভ টিজিংয়ের বিরুদ্ধে উঠান বৈঠকটি ডাকা হয়। লালখান বাজারের বিট পুলিশ কমিটি (নম্বর ৩৯) এর আয়োজন করে।

২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরে পুলিশ সেবা সপ্তাহ শুরু হয়েছে। চলবে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

নগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো হওয়া উচিত ছিল না। তাহলে তাদের (চিহ্নিত সন্ত্রাসী) নিয়ে বৈঠক করেছে? আমি তাদের দু-একজন সম্পর্কে জানি। তারা ভালো নয়। এ বিষয়ে আমি ব্যবস্থা নেব।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈঠকে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহসম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস খুন এবং একটি ধর্ষণ মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি মো. জাহেদ, সুদীপ্ত খুনের আরেক আসামি আইনুল কাদের ওরফে নিপু, যুবলীগ কর্মী মো. শরীফ হত্যার অভিযোগপত্রভুক্ত এবং পুলিশের ওপর হামলা মামলার আসামি ওয়াসিম উদ্দিন এবং সুদীপ্ত ও শরীফ হত্যার আসামি মাঈন উদ্দিন হানিফ উপস্থিত ছিলেন।

নগর ছাত্রলীগ নেতা সুদীপ্ত বিশ্বাস খুন হন ২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর। নগরের নালাপাড়ায় তাঁকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ইতিমধ্যে এই খুনের ঘটনায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। মামলাটি এখন তদন্ত করছে পিবিআই। আর যুবলীগ কর্মী মো. শরীফ লালখান বাজারের বাঘঘোনায় খুন হন ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল বিকেলে। এ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর। এ ছাড়া লালখান বাজারের মতিঝরনার একটি পাহাড়ে নারী পোশাক শ্রমিক ধর্ষণের শিকার হন ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি রাতে। এই মামলায় ১০ জনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ।

উঠান বৈঠকে মাঈন উদ্দিন হানিফ বক্তব্য দেন। তিনি সন্ত্রাস ও মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।

তাঁর এই বক্তব্যে উপস্থিত লোকজনের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা খুনের অভিযোগ ছাড়াও আরও চারটি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। বাকি তিনজনের মধ্যে ওয়াসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে আটটি, মো. জাহেদের বিরুদ্ধে চারটি এবং আইনুল কাদেরের বিরুদ্ধে দুটি ফৌজদারি মামলা রয়েছে।

এদের মধ্যে তিনজন চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজারের মতিঝরনা বস্তিতে এবং আইনুল কাদের লালখান বাজারের চানমারি সড়ক এলাকার একটি মেসে থাকেন। আইনুল কাদেরই কেবল কলেজে পড়েছেন। বাকি তিনজন স্কুলের গণ্ডি পার হননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের বিতর্কিত দু-এক নেতা তাঁদের পৃষ্ঠপোষক। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ এফ কবির আহমেদকেও তাঁরা ‘মুরুব্বি’ মানেন। পদে না থাকলেও কাউন্সিলর কবির আওয়ামী লীগ সমর্থক কাউন্সিলর হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেন। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি জমি বেদখল, অবৈধ সম্পদ অর্জন, মসজিদ ও স্কুলের তহবিল তছরুপের অভিযোগে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান শুরু করেছে।

বৈঠক সম্পর্কে এ এফ কবির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাস, জঙ্গি ও মাদকের বিরুদ্ধে পুলিশ-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠান বৈঠকের ব্যবস্থা করেছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে উঠান বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলাম। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নিয়ে উঠান বৈঠক কেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আসলে কেউ যদি আসামি হয় সেটা আদালত দেখবেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নেবে।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের খুলশী থানার ওসি শেখ নাসির উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাদের (তারকা সন্ত্রাসী) নিয়ে বৈঠক করা কি অপরাধ? তারা আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসেছে। জামিন পেয়ে কেউ ভালো কাজে অংশ নিলে সমস্যা তো থাকার কথা নয়।’

তবে উঠান বৈঠক সম্পর্কে লালখান বাজারের একজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে জানান, এ ধরনের বৈঠক দেখে জনমনে স্বস্তির পরিবর্তে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। একটি থানার ওসি কীভাবে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বৈঠক করেছে তা দেখে মানুষ বিচলিত ও ক্ষুব্ধ।

এই বাসিন্দা আরও জানান, সরকার যেখানে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করেছে, সেখানে এই পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।