'সাহসের জাদুঘরে' ঢুকবে হতাশ মানুষ, বেরোবে আশা নিয়ে

শাহীন রেজা রাসেল মনে করেন, মনের জোরই আসল জোর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
শাহীন রেজা রাসেল মনে করেন, মনের জোরই আসল জোর। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

‘বেকার মাসকুলার ডিসট্রফি’ খটমট একটি রোগের নাম। এখন পর্যন্ত স্নায়ুতন্ত্রের এ রোগটি থেকে মুক্তি পেতে কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি পৃথিবীতে। শাহীন রেজা রাসেলের এ রোগটির সঙ্গে পরিচয় হয় কিশোর বয়সে, মাত্র দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়। রাসেলের এখন বয়স ৩৪ বছর। এ রোগের কারণে দুই পায়ের মাংসপেশি অকার্যকর হয়ে গেছে। হাতের মাংসপেশিও অকার্যকর হওয়ার সংকেত দিচ্ছে। চিকিৎসকেরা দুই বছর আগে জানিয়ে দিয়েছেন, রাসেল আয়ু আছে খুব বেশি হলে পাঁচ বছর। কিন্তু তাতে কি? তাই বলে কি জীবন থেমে যাবে? স্বপ্ন থেমে যাবে?

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার সহকারী পরিচালক শাহীন রেজা রাসেল বললেন, ‘চিকিৎসকের নির্ধারণ করা সময় বলছে, আমার হাতে খুব কম সময় আছে। মনের জোর আর সাহসের কারণে আমার বিশ্বাস এ সময়ের চেয়েও একটু বেশি সময় আমি ভালো থাকতে পারব। তবে মৃত্যু তো আসবেই। কিন্তু মরে যাওয়ার আগেই মরতে চাই না, জীবনটাকে উদ্‌যাপন করেই মরতে চাই।’

পরিকল্পনা জানতে চাইলে রাসেলের দুই চোখে স্বপ্ন খেলা করে। জানালেন, তাঁর মাথায় ‘সাহসের জাদুঘর’ করার পরিকল্পনা ঘুরছে। মানুষ হতাশ হন, আবার কিছু মানুষকে দেখেই তারা উজ্জীবিত হন। কেউ হয়তো দুটি কৃত্রিম পা দিয়েই এভারেস্ট জয় করেছেন। কেউ মুখ দিয়ে ছবি আঁকছেন। স্টিভেন হকিংয়ের গল্প যে কাউকে নতুন ভাবে চিন্তা করতে শেখাবে। দেশে বিদেশের নানান প্রতিবন্ধকতার পরও সফল মানুষদের গল্প, তাঁদের ব্যবহার করা জিনিসপত্র থাকবে সাহসের জাদুঘরে। এ জাদুঘরে হতাশ মানুষ ঢুকলে বের হবেন এক বুক আশা নিয়ে।
এক সময় হাঁটতে পারলেও এখন রাসেলের নিত্যসঙ্গী একটি হুইল চেয়ার। শিল্পকলা একাডেমিতে তিনি কাজ করছেন ২০১৩ সাল থেকে। শুরুতে মহাপরিচালকের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। হুইল চেয়ার সঙ্গী হওয়ার পর পুরোনো ভবনটিতে হুইল চেয়ার নিয়ে যাতায়াতের র‍্যাম্প না থাকায় তিনি জাতীয় চিত্রশালার এ পদের দায়িত্ব নেন।

মঙ্গলবার শিল্পকলা একাডেমিতে শাহীন রেজা রাসেলের অফিস কক্ষে বসেই কথা হয়। কথা বলার ফাঁকে তিনি তাঁর দাপ্তরিক দায়িত্বও পালন করছিলেন। জানালেন তাঁর অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা।
একটি কিশোর যখন প্রথম জানতে পারে সে আস্তে আস্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছে সে কি তা সহজভাবে মেনে নিতে পেরেছিল?-একটু হেসে রাসেল বললেন,‘কিশোর বয়সে এ রোগের কথা জানার পর আমি মেনে নিতে পারিনি। এক বছর স্কুলের পড়াশোনাও ঠিকমতো করতে পারিনি। হতাশা গ্রাস করেছিল। বাড়ির কাছে একটি লাইব্রেরি ছিল, দিনের বেশির ভাগ সময় কাটত সেখানেই। আর সেখানেই পরিচয় হয় পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিতজ্ঞ স্টিভেন উইলিয়াম হকিংসহ অনেকের সঙ্গে। তাঁদের জীবনী পড়ে বুঝতে পারি, আমি ভুল করছি। তারপর জীবনকে নিয়ে নতুনভাবে উপলব্ধির জন্ম।’

জীবনটাকে উদ্‌যাপন করে তবেই মরতে চান শাহীন রেজা রাসেল। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন
জীবনটাকে উদ্‌যাপন করে তবেই মরতে চান শাহীন রেজা রাসেল। ছবি: সাবরিনা ইয়াসমীন

জন্মের পর একদম সুস্থ ছিলেন রাসেল। ২০০০ সালে একটু জ্বর হয়েছিল, তারপর চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসক কিছু একটা সন্দেহ করেন। ঢাকার বড় বড় হাসপাতাল হয়ে কলকাতার বেলভিউ ক্লিনিকের চিকিৎসক অভিজিৎ চ্যাটার্জি জানালেন রোগটির কথা। বয়স অল্প হলেও সত্যটা জানতে হবে বলেই চিকিৎসক রাসেলকে জানিয়েছিলেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে রাসেলের সঙ্গী হবে হুইল চেয়ার। প্রস্রাব-পায়খানার নিয়ন্ত্রণ কমে আসবে।
রাসেল বেশ দৃঢ় গলায় ১০ বছরকে টেক্কা দেওয়া প্রসঙ্গে বললেন,‘জেনেটিক এ রোগটির কারণে শরীরে নানান জটিলতা জানান দেওয়া শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। তবে শুধু আমার মনের জোরে এই হুইল চেয়ার সঙ্গী হতে সময় লেগেছে সাড়ে ১৬ বছর।’ শারীরিক নানান জটিলতা নিয়ে রাসেল জানালেন, এখন দুই পায়ে মশা বসলেও তিনি টের পান। কিন্তু পা দিয়ে হাঁটা সম্ভব হয় না এমনকি দাঁড়াতেও পারেন না। বুঝতে পারছেন দুই হাতের শক্তি আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। এভাবে এক সময় হার্ট এবং ফুসফুসের মাংসপেশি অকার্যকর হয়ে যাবে এবং একসময় তা মৃত্যু পর্যন্ত নিয়ে যাবে।

বর্তমান কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাসেল জানান, তিনি তিরন্দাজ নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করেন ২০০৯ সালে। দুটো মঞ্চ নাটক এবং ১৪টি পথনাটক লিখেছেন। রক্তঋণ নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে হুইল চেয়ার নিয়েই অভিনয় করেছেন রাসেল। রাসেল এ পর্যন্ত নিজের বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা ছাড়াও শিল্পকলা একাডেমির প্রায় তিন হাজার গ্রাফিক ডিজাইন করে দিয়েছেন। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার ছেলে মেয়েরা যাঁরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তাঁদের নিয়ে গড়ে তোলেন প্রজ্বলন নামের একটি সংগঠন। দুই ঈদে সংগঠনের সদস্যরা বাড়ি গেলে জ্ঞান উৎসব, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা, গাছ লাগানোসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। লাঠিখেলা, বাউলগানের মতো বিভিন্ন খেলার আয়োজন করেন।

আবৃত্তি সংগঠন বৈঠকের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাসেল। এ পর্যন্ত রাসেলের লেখা তিনটি কবিতার বই বাজারে এসেছে। এবারের বই মেলায় ‘মন গহিনে বিরান বাড়ি’ নামের একটি কবিতার বই প্রকাশিত হবে। এ পর্যন্ত রাসেলের নিজের লেখা ও সুর করা গানের সংখ্যা ১৮টি। রাসেলের মতে, মৃত্যুর চিন্তা মাথা থেকে দূরে রাখতে সংস্কৃতিকে একটি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

আলাপের প্রায় পুরো সময়ে রাসেল বারবার কৃতজ্ঞতা জানান স্ত্রী জাকিয়া হাসানাতের প্রতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে রাসেলের সহপাঠী ছিলেন জাকিয়া। পাঁচ বছর ভালোবাসার সম্পর্কের পর বিয়ে করেন তাঁরা। স্বামীর বিভিন্ন কাজে সহায়তা করতে গিয়ে ভালো ফলাফল করেও কোনো চাকরি করা হয়নি জাকিয়ার।