নতুন বিন্যাসে একুশে বইমেলা

সাজসজ্জায় নতুন চেহারায় পাঠকের কাছে হাজির হচ্ছে একুশে গ্রন্থমেলা। গতকাল বিকেলে।  ছবি: সাইফুল ইসলাম
সাজসজ্জায় নতুন চেহারায় পাঠকের কাছে হাজির হচ্ছে একুশে গ্রন্থমেলা। গতকাল বিকেলে। ছবি: সাইফুল ইসলাম
>

*প্রথমবারের মতো এবার মেলায় থিম নির্ধারণ করা হয়েছে
*‘বিজয়: ৫২ থেকে ৭১’ থিমে ‘উনিশ’ সংখ্যাটিকে প্রাধান্য
*মেলায় পাঠক–দর্শনার্থীদের সুবিধাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার

বইমেলা শুরুর আগে কেমন থাকে, সেটাই দেখতে এসেছিল পুরান ঢাকার বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। গত বছর পরীক্ষা থাকায় বইমেলায় আসা হয়নি। এবার প্রতিদিনই আসার ইচ্ছা কেরানীগঞ্জের এই কিশোরীর। গতকাল বৃহস্পতিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি নির্মাণাধীন প্যাভিলিয়নের সামনে বসা খাদিজার চোখমুখে বিস্ময়, এত বড় আয়োজন!

আসলেই অনেক আয়োজন দেখা গেছে বৃহস্পতিবার বেশ খানিকটা রাত পর্যন্ত; মেলার স্টলগুলোর ভেতরে-বাইরে চলেছে হাতুড়ি-পেরেকের ঠোকাঠুকি, রং-ব্রাশের মাখামাখি। নির্মাণ, সাজগোজের এই কর্মযজ্ঞের উপলক্ষ একটিই—বইয়ের মেলা। আজ ভাষার মাসের প্রথম দিন থেকেই বাংলা একাডেমি চত্বরে মাসব্যাপী বইমেলা শুরু। আজ বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া উদ্বোধনীতে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কবি শঙ্খ ঘোষ ও মিসরীয় লেখক ও সাংবাদিক মহসিন আল-আরিশি উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। শুধু আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। বিকেল পাঁচটার পর সাধারণ দর্শক-পাঠকের জন্য খুলে যাবে মেলার দরজা।

প্রথমবারের মতো এবার মেলায় থিম নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘বিজয়: ৫২ থেকে ৭১’ থিমে সাজাতে গিয়ে ‘উনিশ’ সংখ্যাটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কেন ‘উনিশ’ সেই ব্যাখ্যাও রয়েছে।

তিন বছর আগে বাংলা একাডেমির সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাটি পায় একুশে বইমেলা। তবে সাজসজ্জা বিন্যাস ছিল পুরোনো ধ্যানধারণার। ছুটির দিনগুলোসহ বিশেষ ভিড়ের দিনগুলোতে মেলায় আসা দর্শক বা পাঠকদের নিদারুণ ভোগান্তি হতো। এবার তেমনটি হবে না বলে আশাবাদী আয়োজকেরা।

বাংলা একাডেমি থেকে মেলা শুরু হলেও দেশের মূল সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থাগুলো থাকবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান চত্বরে। আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতাস্তম্ভের গ্লাস টাওয়ারকে প্রাধান্য দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে মেলার পরিসর। ভাগ হয়েছে পাঁচজন ভাষাশহীদের নামে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে দেখা হয় স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝরের সঙ্গে। তিনি এবার মেলা সাজানোর নকশাটির সার্বিক পরিকল্পনা করে দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে স্থাপত্যচর্চা প্রতিষ্ঠান সিস্টেম আর্কিটেক্টসের কর্মী এবং শিল্পী সব্যসাচী হাজরা, লিটন কর, মেহেদী হক, এ এ মারুফ কাজ করেছেন মেলার সাজানোসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে এনামুল করিম নির্ঝর প্রথম আলোকে বলেন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকে মাথায় রেখে সমকালীন শৈল্পিক ধারণা নিয়েই এবার মেলা সাজানোর আয়োজন চলছে। মেলার সঙ্গে যুক্তিসংগতভাবেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতাস্তম্ভের যোগাযোগ তৈরি হবে। স্বাধীনতাস্তম্ভের গ্লাস টাওয়ারের আলোয় আলোকিত হবে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলায় আগত দর্শক বা পাঠক স্তম্ভের জলাশয়ের পাশে বসতে পারবেন। এনামুল করিম বলেন, ‘বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে নয়, বরং মেলা কমিটির সদস্য হয়ে একজন স্থপতি হিসেবে পেশাজীবীর দায়িত্ববোধ থেকেই কাজ করছি।’

এবার ‘উনিশ’ সংখ্যাটি মাথায় রেখে মেলা সাজিয়েছেন এনামুল করিম। এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন, ‘এ বছর যেমন উনিশ সালে মেলা হচ্ছে, তেমনি এই সংখ্যাটি আমাদের জাতীয় জীবনে কাকতালীয়ভাবে মিশে গেছে। ১৯৫২ সাল থেকে ৭১, উনিশ বছর, ৭১ থেকে ৯০, উনিশ বছর। সব মিলিয়ে এই সংখ্যাটিকেই মাথায় রেখেছি।’

বইমেলায় পাঠক ও দর্শনার্থীদের সুবিধাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানালেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। তিনি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিগত দিক থেকে মেলাকে একটি সমৃদ্ধ জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। স্বাধীনতাস্তম্ভের কাছে মেলার মাঠের পূর্ব দিকে একটি মঞ্চ দেখিয়ে বললেন, এটি এবারের মেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ‘লেখক বলছি’ নামের মঞ্চে প্রতিদিন পাঁচজন লেখক তাঁর নতুন বই নিয়ে কথা বলবেন। এখানে অংশ নেওয়ার জন্য আগের দিন বই জমা দিতে হবে। সেখান থেকে বাছাইয়ের মাধ্যমে লেখক ও বই নির্বাচন করা হবে।

গতকাল দুপুরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকার নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শন করেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।

তৃতীয়বারের মতো এবারও মেলার সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের মালিকানাধীন নিরাপদ মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন।

মেলা প্রাঙ্গণে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হলো শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবিন আহসানের সঙ্গে। কর্মীদের সঙ্গে নিজেই স্টল সাজানোর কাজে ব্যস্ত। মেলার বিন্যাসের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, ‘মেলার বিন্যাস খুব সুন্দর হয়েছে। হাঁটাচলা করতে সুবিধা হবে। ভিড়ের দিনগুলোতে এ বিন্যাসের ভালো ফল পাওয়া যাবে।’