ধর্ষণের পর নারীকে ইয়াবায় ফাঁসাল পুলিশ

>
  • ধর্ষণের পর নারীকে নির্জন জায়গায় ফেলে রাখল পুলিশ
  • নারীর কাছ থেকে দুই হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার
  • পরে সাজানো মামলা
  • আদালতের নির্দেশে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এল আসল ঘটনা

এক নারীকে ধর্ষণের পর গাড়িতে তুলে নিয়ে নির্জন স্থানে ফেলে রাখা হয়। এরপর পুলিশ গিয়ে ওই নারীর কাছ থেকে দুই হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার দেখিয়ে মামলা করে। এই সাজানো মামলায় চার মাস কারাভোগ করেন তিনি।

সীতাকুণ্ড থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) তিন পুলিশ সদস্য মামলাটি সাজিয়েছেন। তাঁদের সহযোগিতা করেন ওই নারীর স্বামীর প্রথম স্ত্রীর সন্তানেরাসহ ১৩ জন। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তদন্তে বিষয়টি উঠে এসেছে।

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সম্পত্তির ভাগ না দিতে ওই নারীকে ধর্ষণের পর ইয়াবাসহ পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হয়। তদন্তে তিন পুলিশ সদস্য সম্পৃক্ত থাকার সত্যতা পাওয়া গেছে। ২২১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে বিস্তারিত বলা হয়েছে। আরেক তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক আবু জাফর মো. ওমর ফারুকও একই কথা বলেন।

ঘটনাটি গত বছরের ২৯ আগস্টের। ওই দিন বিকেলে ওই নারীকে নিয়ে তাঁর স্বামী হালিশহর থানায় যান। স্বামী অভিযোগ করেন, তাঁর প্রথম স্ত্রীর সন্তানেরা দ্বিতীয় স্ত্রীকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করছেন এবং ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। এই অভিযোগ করে তিনি সন্ধ্যায় স্ত্রীকে বাসায় রেখে দোকানে যান। রাতে ফিরে দেখেন বাসার জিনিসপত্র এলোমেলো, স্ত্রী নেই। পরদিন দুপুরে খবর পান, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়ে তাঁর স্ত্রী সীতাকুণ্ড থানায়। পুলিশের করা মাদক মামলায় কারাগারে যান স্ত্রী।

এরপর স্ত্রীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগে আদালতে মামলা করেন স্বামী। আদালত ডিবি পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন। অপরদিকে স্ত্রীর জামিনের আবেদন করলে চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত বিষয়টি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যে ধর্ষণ, অপহরণ ও ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর বর্ণনা দিয়ে ওই নারী আদালতে জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া তাঁর প্রথম স্বামীও ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর কথা উল্লেখ করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

বাদীর আইনজীবী প্রণব মুখার্জি বলেন, পুলিশের করা মাদক মামলাটি প্রত্যাহার চেয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি ডিবি ও পিবিআইয়ের প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। একই সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করা হবে।

দুটি সংস্থার প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন সীতাকুণ্ড থানার সাবেক ওসি ইফতেখার হাসান, উপপরিদর্শক (এসআই) সিরাজ মিয়া, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) জাকির হোসাইন, ওই নারীর স্বামীর মৃত প্রথম স্ত্রীর ছেলে, তাঁর স্ত্রী, বড় মেয়ে, তাঁর স্বামী, ছেলের শ্যালক, তাঁদের চার সহযোগী ও ওই নারীর প্রথম স্বামী। তাঁরা কেউ গ্রেপ্তার হননি। নির্যাতন করে মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথম স্ত্রীর ছেলে বলেন, তিনি এসব কাজে জড়িত নন। তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।

যেভাবে ফাঁসানো হয়
পিবিআই ও ডিবির তদন্ত থেকে জানা যায়, নগরের হালিশহরের বাসা থেকে ওই নারীকে মাইক্রোবাসযোগে সীতাকুণ্ডের কুমিরা গেট এলাকার নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে তাঁর কোমরে দুই হাজার ইয়াবা বড়ির একটি ব্যাগ গুঁজে রাখা হয়। রাত দেড়টার দিকে ওই এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশের এসআই সিরাজ মিয়া দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে ইয়াবাগুলো জব্দ করেন। এতে নারী কনস্টেবল হালিমা আক্তারসহ চারজনকে সাক্ষী রাখা হয়। ওই নারী অচেতন থাকায় তাঁকে সীতাকুণ্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক ভর্তির পরামর্শ দেন এবং এটা ‘পুলিশ কেইস’ বললেও শোনেননি এসআই সিরাজ মিয়া। পরদিন সীতাকুণ্ড থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় ওই নারীকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মাদক মামলার জব্দ তালিকায় স্থানীয় বাসিন্দা আলী শাহকে দ্বিতীয় সাক্ষী রাখা হয়েছে। তিনি সীতাকুণ্ড থানার ওসি ইফতেখার হাসান, এসআই সিরাজ মিয়া ও এএসআই জাকির হোসাইনের সঙ্গে ২৯ আগস্ট বিকেল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত ১৫–১৬ বার মুঠোফোনে কথা বলেন। ইয়াবা উদ্ধারের সময় নারী কনস্টেবল না থাকায় পরদিন কনস্টেবল হালিমা আক্তারের কাছ থেকে জোর করে সই নেওয়া হয় জব্দ তালিকায়। নিয়ম অনুযায়ী সংবাদদাতা আলী শাহকে মামলার বাদী করা হয়নি। ইয়াবা জব্দকারী এসআই সিরাজ মিয়া নিজেও বাদী হননি। কনস্টেবল হালিমাকে ধমক দিয়ে জব্দ তালিকায় সিরাজ মিয়া সই নেন বলে তদন্তে জানা যায়।

এসআই সিরাজ মিয়া সীতাকুণ্ড থেকে বদলি হয়ে বর্তমানে রাঙামাটি জেলা ডিবি পুলিশে কর্মরত রয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘থানার মালিক আমি না। ওসির নির্দেশে সব হয়েছে।’

সীতাকুণ্ড থানার ওই সময়ের ওসি ইফতেখার হাসান বর্তমানে মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থানায় কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, থানার কর্মকর্তারা ইয়াবা উদ্ধার করেছেন। যদি কাউকে ফাঁসানো হয়ে থাকে, তবে তদন্ত করে বাদ দেওয়া উচিত। যখন অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল তখন তিনি সীতাকুণ্ডে ছিলেন না।

ওই নারী জানুয়ারির শুরুতে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ধর্ষণ করেও ওরা থেমে থাকেনি। পুলিশের সহায়তায় ইয়াবা দিয়ে মামলা করায়। তিনি জড়িত ব্যক্তিদের এমন শাস্তি চান, যাতে কোনো মেয়ের জীবন এভাবে কেউ তছনছ করতে না পারে।