বাহাদুরির খেলায় মুক্তিপণ-বাণিজ্য

>
  • নবম শ্রেণি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা জড়িত 
  • গ্রেপ্তার ৫০, পুলিশি নজরদারিতে আরও শতাধিক 
  • স্প্যামারদের তালিকা তৈরি করছে পুলিশ।

দিনের অনেকটা সময় ফেসবুকে কাটাচ্ছেন, বন্ধু-স্বজনদের খবর নিচ্ছেন, ছবি আপলোড করছেন, তর্কে জড়াচ্ছেন কখনো, কখনো বন্ধুত্বেও। আপনি কি জানেন সাধের এই ফেসবুক আইডিটি যেকোনো সময় হাপিস হয়ে যেতে পারে। সে জন্য ওত পেতে আছে অনেকগুলো দল, যাদের ডাকনাম ‘স্প্যামার’। ইচ্ছা হলে ভালোয় ভালোয় ওরা দখল করা আইডি ফিরিয়ে দিতে পারে, ভাগ্য খারাপ হলে পণের জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করা লাগতে পারে।

এই সময়ের জনপ্রিয় নায়ক সিয়াম সম্প্রতি পড়েছিলেন স্প্যামারদের পাল্লায়। সিয়াম বলেন, দহন ছবিটি মুক্তির আগে নিজের ফেসবুক আইডি থেকে যখন প্রচারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনই দেখলেন নিজের আইডি খোয়া গেছে। পুলিশের সহায়তায় ২৫ দিন পর আইডি ফেরত পেলেন ঠিকই, ছবি মুক্তির জন্য তখন মাত্র দুদিন সময় আছে।

খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, সিয়ামের মতো হতাশ মানুষের সংখ্যা কম নয়। কয়েকজন তারকাও আছেন এ তালিকায়। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত উপকমিশনার নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গেল দুই বছরে কমপক্ষে ৫০ জন স্প্যামারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। আরও শতাধিক অভ্যাসগত স্প্যামারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

স্প্যামারদের হামলা নিয়ে সিটিটিসি তাদের ফেসবুক পেজে দেওয়া বিবৃতিতে বলেছে, অন্যের ফেসবুক প্রোফাইল (ক্ষেত্রবিশেষে ফেইক বা ক্ষতিকারক প্রোফাইল ছাড়া) ডিজঅ্যাবল করা বা যেকোনো উপায়ে অন্যের প্রোফাইলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া বা নেওয়ার চেষ্টা করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শখের বশে বা ঘৃণাবোধ থেকে বা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অথবা কখনো কখনো ‘বুনো ফ্যান্টাসি’র জন্য এই কাজ করবেন না।

স্প্যামার কারা? তারা আসলে করছে কী? জানতে চাইলে ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো বলছে, দলবদ্ধ হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরা কোনো একজন ব্যক্তির পিছু নেয়। তারপর সেই লোকের বিরুদ্ধে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করে তাঁর আইডি নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এরপর শুরু হয় তাদের প্রতারণা বা ভয় দেখানো।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা জানান, সিনেমা-নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্রে যাঁরা অভিনয় করেন, এমন কমপক্ষে ২০ জনের আইডি নিষ্ক্রিয় করেছে দলগুলো। উপযুক্ত প্রমাণ দেখিয়ে পরে আইডি ফেরত পেলেও এসব করতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্প্যামার প্রথম আলোকে বলেন, এসব কাজে কমপক্ষে ২০টি দল সক্রিয় আছে, তাদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচটি দল টাকাপয়সার বিনিময়ে আইডি ফেরত দেয়। এ জন্য তাঁরা দু-এক হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করে থাকেন। অনেক সময় প্রেমিক-প্রেমিকারা পরস্পরের ওপর নজরদারি করতে স্প্যামার নিয়োগ করেন। দলগুলোতে নবম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা আছেন।

যেভাবে ফাঁদে ফেলে স্প্যামাররা

ই-মেইলে আসা ‘স্প্যাম’ থেকে শব্দটার উৎপত্তি। ই-মেইলে যেমন হুড়মুড়িয়ে স্প্যাম মেইল আসে, স্প্যামাররাও তেমনি কারও ফেসবুকের টাইমলাইনে ঢুকে প্রথমে একযোগে গালিগালাজ করতে থাকেন। তারপর দলবদ্ধভাবে ফেসবুকের কাছে কোনো নির্দিষ্ট একটি আইডির বিরুদ্ধে গাদা গাদা অভিযোগ দেন। এতে সেই আইডি হারিয়ে যায়। ফেসবুকে সক্রিয় গ্রুপগুলোর মধ্যে আছে ডনস টিম, ইম্পেরিয়াল ট্রাইব, গুন্ডা গ্যাং, লিডার গ্যাং, ব্ল্যাক মেটাল, অ্যানোনিমাস, মাফিয়া, ডেঞ্জারাস ফোর্স, টক্সিক ইত্যাদি। কিছু গ্রুপের অ্যাডমিন বিদেশে বসে কাজ করেন। দেশের ভেতর থাকেন তাঁদের সহযোগীরা।

ওয়াকিবহাল একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুকে রিপোর্টের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী রিপোর্ট হলো সমাজে অগ্রহণযোগ্য এমন কিছু পোস্ট করার অভিযোগ, যেমন ‘নগ্নতা’। তা ছাড়া আইডির যিনি মালিক, তিনি আসলে মালিক নন, অন্য কেউ, এমনটা জানিয়েও রিপোর্ট করেন স্প্যামাররা। কখনো কখনো ছবি বা কপিরাইটের কারণে আইডি নিষ্ক্রিয় হতে পারে। কেউ যখন সত্যিকারের আইডির মালিককে চ্যালেঞ্জ করে বসেন, তখন তাঁকে প্রোফাইলটির মালিকানা প্রমাণ করতে হয়। তিনি আরও বলছিলেন, ‘ধরুন আপনি আপনার আইডিতে একটা ছবি দিলেন পাহাড় বা সমুদ্রের। স্প্যামাররা অল্প কিছু ডলার দিয়ে ফ্রি ওয়েবসাইট ডমেইন কেনেন। তারপর একই ছবি, একই ক্যাপশন দিয়ে তারিখটা পিছিয়ে দেন। আপনি আপলোডের যে তারিখ দেবেন, স্প্যামার দেবেন তারও আগের। তারপর ফেসবুকে তাঁদের লিঙ্ক দেবেন এবং দাবি করবেন আইডির মালিক আপনি নন। কপিরাইট ভায়োলেশনের জন্য ফেসবুক তখন সেই আইডি নিষ্ক্রিয় করে দেবে।’ আইডি নিষ্ক্রিয় হওয়ার পর একদিন লগইনের পর ফেসবুক বলবে, ‘সম্প্রতি আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে সন্দেহজনক কিছু কার্যক্রম চোখে পড়ছে। আপনার অ্যাকাউন্ট ফিরিয়ে দিতে কয়েকটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।’

স্প্যামারদের কাছ থেকে নিজের ফেসবুক আইডি কী করে সুরক্ষিত রাখা যায়? এ নিয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভাগীয় প্রধান জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, অপরিচিত কোনো ডিভাইস থেকে কেউ লগইনের চেষ্টা করলে ব্যবহারকারী খবর পেয়ে যাবেন। ব্যক্তিগত ডিভাইসগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যেমন পাসওয়ার্ড অটোসেভ না রাখা এবং অপরিচিত কোনো লিঙ্কে ক্লিক না করাই ভালো।