স্বল্প মূল্যের ও ছোট আকারের ফ্ল্যাট নির্মাণে গুরুত্বারোপ

‘আবাসন খাতের সমস্যা ও সমাধানের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। প্রথম আলো ও রিহ্যাব এই বৈঠকের আয়োজন করে। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
‘আবাসন খাতের সমস্যা ও সমাধানের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। প্রথম আলো ও রিহ্যাব এই বৈঠকের আয়োজন করে। কারওয়ান বাজার, ঢাকা, ৩ ফেব্রুয়ারি। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্ল্যাট বা প্লট কেনার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আর নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলেছেন, নগরবাসীর আবাসন সংকট মোকাবিলার জন্য স্বল্প মূল্যের ও ছোট আকারের ফ্ল্যাট নির্মাণে জোর দিতে হবে।

আজ রোববার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো সম্মেলন কক্ষে এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা উঠে আসে। ‘আবাসন খাতের সমস্যা ও সমাধানের উপায়’ শীর্ষক এই গোলটেবিলের আয়োজন করে প্রথম আলো ও রিহ্যাব। গোলটেবিল আলোচনায় কম মূল্যের ও ছোট আকারের ফ্ল্যাট নির্মাণের ওপর জোর দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানে রিহ্যাবের নেতারা বলেন, রিহ্যাবের অনুমোদিত সদস্য আছে। তাদের কাছ থেকে ফ্ল্যাট বা প্লট কিনলে কেউ প্রতারিত হবেন না। যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে তাহলে তা রিহ্যাবকে জানালে তারা সমস্যা সমাধান করেন। কিন্তু রিহ্যাবের সদস্য নয় এমন কারও কাছে কিছু কিনলে তারা সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না। সে জন্য রিহ্যাব অনুমোদিত সদস্য তালিকা থেকে ফ্ল্যাট বা প্লট কেনার পরামর্শ দেন তাঁরা।

রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, আগামী মার্চ থেকে আমরা অনলাইনে সব নকশার অনুমোদনের কাজ শুরু করছি। এতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। আমাদের তালিকা আছে। সেই তালিকা ধরে অনুমোদিত আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্লট বা ফ্ল্যাট কিনলে প্রতারিত হবেন না। পুরোনো নগরায়ণের ভেতরে কীভাবে সমন্বয় করে জায়গা বের করে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যায় তা আমরা নিশ্চিত করার কাজ করে যাচ্ছি। নতুন আবাসন গড়ে উঠলে সেখানে যাতে সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হয় সে জন্য আমার কাজ করছি। ড্যাপ জনবান্ধব করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।

গোলটেবিলে বক্তারা বলেন, ফ্ল্যাট বা প্লট কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংকের উচ্চ সুদে ঋণ দেয়। এ কারণে চাহিদা থাকার পরও সবাই এসব কিনতে পারে না। তাই এ ক্ষেত্রে সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। তাহলে মানুষ কম সুদে ফ্ল্যাট ও প্লট কিনতে পারবে। এতে আবাসন সমস্যা দূর হবে।

গোলটেবিলে নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম বলেন, সবাই সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দেন। কিন্তু বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। কারণ সিঙ্গাপুরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। এ দেশে আবাসন ব্যবস্থা বৃদ্ধিতে রিহ্যাবের ভূমিকা অনেক। তাঁরা পেশাগত দক্ষ। তারা পেশাদার হলে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকবে। সাধারণ মানুষের আবাসন সহায়তা দিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। রিহ্যাবের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধিতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে সংস্থাটিকে। যেসব প্রতিষ্ঠান মানুষের আস্থা অর্জন করবে তাদের সরকারের সমর্থন দিতে হবে। একটি ভালো তালিকা হলে মানুষ তা দেখে নিতে পারবে এতে আস্থা বাড়বে মানুষের। এ জন্য সর্ব স্তরে সুশাসন দরকার বলে মনে করেন এই নগরবিদ।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, সারা দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১ হাজার ৭০০ ফ্ল্যাট তৈরি হয়েছে। মোট ২২ হাজার ফ্ল্যাট তৈরি হবে। এ ছাড়া বস্তিবাসীদের জন্য ১১ হাজারের মতো ফ্ল্যাট তৈরি করা হবে। আমরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাড়ি তৈরি করছি। আবাসন ব্যবসায়ীরাও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন। এ ছাড়া হাউজ বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই) নদীর তলদেশের খনন করা মাটি দিয়ে পরিবেশবান্ধব ইট, হলব্লক তৈরি করছে যা শতভাগ পরিবেশবান্ধব। এগুলো আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করতে পারে। এতে উর্বর মাটি বা টপ সয়েল রক্ষা সম্ভব হবে।

রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, বর্তমানে আবাসনের চাহিদা অনেক বেশি। ক্রেতাদের চাহিদা থাকার পরও সাধ্যের মধ্যে না থাকার কারণে কিনতে পারছেন না। একদিনে এক কোটি টাকা পরিশোধ করে বাড়ি কেনার সামর্থ্য অনেকেরই নেই। কিন্তু যদি বলা হয় বিশ বছরে এই টাকা শোধ করতে হবে তাহলে অনেকেই তা কিনতে পারবেন। বিল গেটসও একদিনে টাকা দিয়ে বাড়ি কেনেন না।

বর্তমানে ব্যাংকের ঋণে সুদের উচ্চ হারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, উচ্চ সুদের কারণে বাড়ি কিনতে অনেকে ব্যাংক লোন নিতে পারেন না। বেসরকারি ব্যাংকও দীর্ঘ মেয়াদে লোন গ্রাহককে দিতে পারছে না। এ জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার একটি বিশেষ তহবিল করে দীর্ঘ মেয়াদে কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারে। ঢাকাকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তিনি বলেন, সবাই ঢাকায় আসতে চায় এটি কমাতে হবে।

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আবাসন সেক্টরে সমস্যা অনেক এর সমাধান নিরূপণ করা দরকার। আবাসনের চাহিদা অনেক। ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতি পূর্ণ এলাকা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৪৮ হাজারের বেশি লোক বসবাস করে। এর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সেনেগালে ২৮ হাজার লোক বোম্বে তে ২৬ হাজার মানুষ বসবাস করে। সবার জন্য সহজে আবাসন পেতে হলে রাষ্ট্রকে ভূমিকা রাখতে হবে। এই খাতে বিনিয়োগের সমস্যা রয়েছে। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি তানভীরুল হক প্রবাল বলেন, আবাসনের সমস্যা সমাধানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনতে হবে। ভবন করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন পেতে অনেক সময় লাগে। একই ভাবে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ পড়ে থাকে। এতেও অনেক সময় চলে যায়। এটি কমিয়ে আনতে হবে। আবাসন ব্যবসা চাঙা হলে দেশের অর্থনীতির গতিও চাঙা হবে বলে জানান তিনি।

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক বিজয় কুমার মণ্ডল সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বলেন, সরকারের অন্যতম কাজ হচ্ছে সবার জন্য পরিকল্পিত আবাসন। এই লক্ষ্যে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে মধ্যবিত্তের জন্য আবাসন তৈরি করা হচ্ছে। পাবলিক ও প্রাইভেট (পিপি) উদ্যোগে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

গোলটেবিলে বিটিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এফ আর খান, সহসভাপতি কামাল মাহমুদ ও লিয়াকত আলী ভুঁইয়া, রিহ্যাবের পরিচালক শাকিল কামাল চৌধুরী, কনকর্ডের খাইরুল বাসার বক্তৃতা করেন। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।