দেড় শ বছর পর দেখা মিলল যে পাখির

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বনভূমি বাবু ডাইংয়ে গত শুক্রবার দুর্লভ প্রজাতির খয়রা ঝিল্লি পাখির দেখা মিলেছে। ছবি: নূর-এ-সাউদ
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বনভূমি বাবু ডাইংয়ে গত শুক্রবার দুর্লভ প্রজাতির খয়রা ঝিল্লি পাখির দেখা মিলেছে। ছবি: নূর-এ-সাউদ

উনিশ শতকে ঢাকা বিভাগের জলাভূমিতে দেখা মিলত খয়রা ঝিল্লি পাখির। এরপর এই পাখির দেখা মেলেনি—এমনটিই জানা ছিল পাখিপ্রেমীদের। তবে গত শুক্রবার দুর্লভ এই পাখির দেখা মিলেছে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বনভূমি বাবু ডাইংয়ে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটের প্রভাষক পাখিপ্রেমী নূর-এ-সাউদ বনভূমির জলের খাঁড়িতে এর দেখা পেয়েছেন।

বরেন্দ্রভূমির উঁচু-নিচু টিলার অপূর্ব ঢেউখেলানো বনভূমি বাবু ডাইং। এখানে রয়েছে শান্ত জলের আঁকাবাঁকা খাঁড়ি। এই বনভূমিতেই প্রায় দেড় শ বছর পর খয়রা ঝিল্লি পাখির দেখা মিলল বলে জানালেন রাজশাহী বার্ড ক্লাবের সদস্য নূর।

বাবু ডাইং ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য চমৎকার একটি জায়গা। পাখিপ্রেমীরাও সেখানে ছুটি যান দুর্লভ পাখির সন্ধানে। গত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে সেখানে রাতচরা পাখির খোঁজে গিয়েছিলেন নূর-এ-সাউদ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য তারিক হাসান। এই বনভূমির পূর্ব দিকে জলের খাঁড়ি রয়েছে। সেদিক দিয়ে একটি পাখির উড়ে যাওয়ার দৃশ্য নূরের ক্যামেরায় ধরা পড়ল। পাখিটি অচেনা মনে হলো। শনাক্ত করার জন্য তাঁরা বিভিন্ন পাখি বিশেষজ্ঞের কাছে ছবি পাঠান। কিন্তু শুধু উড়ন্ত পাখির ছবি দেখে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁরা আরও বিভিন্ন দিক থেকে পাখিটির ছবি চাইলেন। গত শুক্রবার সেই কাজে নূর আবার বাবু ডাইংয়ে যান। সঙ্গে যান বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সদস্য হাসনাত রনি। সেই জলের খাঁড়ির কাছেই নূর দেখা পেলেন অচেনা পাখিটির। কিন্তু ছবি তোলার আগেই সে ঝোপের আড়ালে চলে যায়।

নূর দুই ঘণ্টা বসে থাকলেন। পাখিটি প্রকাশ্যে এল। ক্যামেরাতেও সে ধরা পড়ল। সেদিনই পাখিটির ছবি বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হয়। তাঁরা নিশ্চিত করেন, এটা খয়রা ঝিল্লি। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞান কোষ’ বইয়ের পাখি খণ্ড-২৬-এ এই পাখির বাংলা নাম দেওয়া হয়েছে খয়রা ঝিল্লি। এর ইংরেজি নাম ‌‌‌Brown Crake।

যাঁরা ছবি দেখে পাখিটির পরিচয় নিশ্চিত করেছেন, তাঁদের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যাপক আ ন ম আমিনুর রহমান। তিনি বলেন, খয়রা ঝিল্লি নতুন দেওয়া নাম। এর আগের নাম হচ্ছে বাদামি ঘুরঘুরি বা কাগ। সম্প্রতি প্রকাশিত অধ্যাপক মনিরুল খানের বইয়েও এই পাখির নাম কাগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ১৮৫৪ সালে একজন ব্রিটিশ কর্নেল ও প্রকৃতিবিদ তাঁর একটি প্রবন্ধে ঢাকা বিভাগের জলাভূমিতে এই পাখি পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করেছিলেন। উপযুক্ত আবাসের অভাব ও শিকারের কারণে এরা হারিয়ে যায়। তবে খুশির খবর, বাংলাদেশের অন্য প্রান্তে এর বাস রয়েছে।

খয়রা ঝিল্লি জলপাই-বাদামি রঙের জলচর পাখি। এর দৈর্ঘ্য ২৮ সেন্টিমিটার, ওজন ১৩০ গ্রাম, ডানা ১২ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৩ সেন্টিমিটার, পা ৫ সেন্টিমিটার, লেজ ৬ সেন্টিমিটার। পিঠের দিক জলপাই-বাদামি, দেহের নিচের দিক ছাই-ধূসর, ঘাড়ের পাশ ছাই-ধূসর, মাঝে মাঝে ভ্রু-রেখা অস্পষ্ট ছাই ধূসর দেখায়, গলা সাদাটে, লেজতল-ঢাকনি ধোঁয়াটে জলপাই-বাদামি। চোখ রক্তের মতো লাল, লালচে ঠোঁটের আগা নীলচে এবং পা ও পায়ের পাতা বাদামি। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির চোখ বাদামি।

খয়রা ঝিল্লি জলাভূমি, বিল ও নানা ধরনের জলাধারে বিচরণ করে। সচরাচর একা বা জোড়ায় থাকে। পানির ধারে ধীরে ধীরে হেঁটে এরা খাবার খোঁজে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে পোকা ও তাদের লার্ভা, শামুকজাতীয় প্রাণী, কেঁচো ও জলজ উদ্ভিদের বীজ। খাওয়ার সময় স্বভাবত এরা লেজ খাড়া রাখে, ভোরে ও গোধূলি বেলায় বেশি কর্মচঞ্চল হয়। জোরে উড়তে পারে না এবং ভয় পেলে উড়ে না গিয়ে দৌড়ায়। মে-আগস্ট মাসে প্রজননকালে জলার ধারে নলবনে বা ঝোপে ঘাস, নলখাগড়া ও ডালপালা বিছিয়ে স্তূপাকারে বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে।

এশিয়াটিক সোসাইটির বইয়ে বলা হয়েছে, খয়রা ঝিল্লি উনিশ শতকে ঢাকা বিভাগের জলাভূমিতে ছিল, এখন নেই। এখন ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও উত্তর চীনের দক্ষিণ থেকে ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। বাংলাদেশে বন্য প্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।