চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে, মানুষ ভুগছে

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি
>

• স্বাস্থ্যের পেছনে যে ব্যয় হয়, তার ৬৭ শতাংশ বহন করে রোগী বা তার পরিবার
• ৩৩ শতাংশ আসে সরকার ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে
• ব্যয় কমানো স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ 

রহিমা বেগমের বয়স ৫০ বছরের কিছু বেশি। বাড়ি শরীয়তপুর জেলার গোসাইরহাট উপজেলার ইদুলপুর গ্রামে। দুই মাস আগে তাঁর পেটে ব্যথা হয়। দুই দফা চিকিৎসা হয় গোসাইরহাট সরকারি উপজেলা হাসপাতালে। তাতে লাভ হয়নি। শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে না গিয়ে তাঁরা ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রহিমার জায়গা হয়েছিল প্রশাসনিক ব্লকের সিঁড়ির নিচে। চিকিৎসা শেষে তিনি বাড়ি ফিরে গেছেন। সঙ্গে ছিলেন স্বামী শফিউদ্দিন খান ও বড় ছেলে আবু সিদ্দিক।

আবু সিদ্দিক পেশায় রাজমিস্ত্রি; পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। মায়ের চিকিৎসায় ৩৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে বলে জানালেন। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দুই কাঠা জমি ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন।

চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে শরীয়তপুরের এ দরিদ্র পরিবারটি আরও দরিদ্র হয়ে পড়ল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।

মাতৃস্বাস্থ্য, শিশুস্বাস্থ্য, মোট প্রজনন হার—এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশংসা ও স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশে পুষ্টি-পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মডেল হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিককে ‘বৈপ্লবিক’ বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, স্বাস্থ্যের পেছনে যে ব্যয় হয়, তার ৬৭ শতাংশ বহন করে রোগী বা তার পরিবার। বাকি ৩৩ শতাংশ আসে সরকার ও দাতা সংস্থার কাছ থেকে। ব্যয় কমানো স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি, দুর্নীতি কমানো, নজরদারি বাড়ানো নতুন সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে তিনি মন্তব্য করেন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের দেওয়া ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ও পরিকল্পনার মধ্যে স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবার উন্নতি করার কথা বলা হয়েছে। তাতে এক বছরের কম বয়সী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী সব নাগরিককে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের সেবাকেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি, সেবার মান বৃদ্ধি ও উপস্থিতি নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যক্তির ব্যয় কমানো, দুর্নীতি কমানো, সেবার মান বাড়ানোসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন ও ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের স্বাস্থ্য খাতের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করা। আমরা তা পারব।’

স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজস্ব ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশ করা বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যয় হিসাবের তথ্য অনুযায়ী, মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ রোগী নিজের পকেট থেকে খরচ করে। বাংলাদেশের কাছাকাছি খরচ হয় আফগানিস্তানে, সেখানে ৬৪ শতাংশ। আর মালদ্বীপে সবচেয়ে কম, ১৮ শতাংশ।

২০১২ সালে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬০ শতাংশ। ওই বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের কৌশলপত্রে বলেছিল, রোগীর নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেবে সরকার। ২০৩২ সালে রোগীর নিজস্ব ব্যয় ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে গত সাত বছরে নিজস্ব ব্যয় কমেনি, বরং বেড়েছে। সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেছেন, সরকার কার্যকর উদ্যোগ না নিলে রোগীর নিজস্ব ব্যয়ের হার আরও বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাণিজ্যিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সেবা নেওয়ার প্রবণতা বাড়ার কারণে নিজস্ব স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে। ব্যক্তির নিজস্ব খরচের ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ যায় ওষুধ কিনতে, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ৮ দশমিক ২ শতাংশ, হাসপাতালে যায় ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। চিকিৎসকদের পেছনে খরচ হয় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বিকল্প চিকিৎসাসেবা ও অন্যান্য খাতে খরচ হয় ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

দেশের মানুষ এখন বেসরকারি খাত থেকে বেশি স্বাস্থ্যসেবা নেয়। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হিসাব বলছে, ৪৯ হাজার ৪১৪টি শয্যা সরকারি হাসপাতালে আর ৮৭ হাজার ৬১০টি শয্যা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে। বহির্বিভাগের আলাদা কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও হিসাবটা এ রকমই হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। রোগনির্ণয়ের পরীক্ষা–নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য।

ব্যয় কমানোর ব্যাপারে স্বাস্থ্যসচিব (সেবা বিভাগ) মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, রোগ প্রতিরোধব্যবস্থার ওপর সরকার বেশি জোর দিচ্ছে, যেন মানুষকে হাসপাতালে কম যেতে হয়। বিভিন্ন রোগের জন্য চিকিৎসাবিধিও তৈরি করা হচ্ছে, যেন অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ব্যবহার করতে না হয়। একই সঙ্গে সরকার আরও বেশিসংখ্যক অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ হাসপাতালে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করছে।

মান নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ট না
স্বাস্থ্য খাতের অর্থায়ন নীতি ও কৌশল নির্ধারণ এবং বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠানের নথিতে বলা হয়েছে, অবকাঠামো, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবলে বিনিয়োগ করার পরও দেশের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য খাতে এটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।

সরকারি কিছু হাসপাতাল ছাড়া মানুষ জরুরি চিকিৎসাসেবা পায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর জন্য বেশি সময় দেন না। রোগনির্ণয়ের পরীক্ষা–নিরীক্ষার একটা অংশ অপ্রয়োজনীয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে। সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও এ কথা সত্যি যে প্রতিবছর বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে যায়। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে অবস্থাপন্ন মানুষেরা। অর্থে কুলালে আরও বেশি মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেত। দেশে চিকিৎসাসেবার মানের ব্যাপারে সন্দেহ থাকায় মানুষ বিদেশে যাচ্ছে।

মানসম্পন্ন সেবার সঙ্গে প্রশিক্ষিত জনবল, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের সম্পর্ক আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মানসম্পন্ন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক, নার্সসহ ২৩ জন স্বাস্থ্যকর্মীর একটি দল থাকা দরকার।

ব্রিটিশ চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ২০১৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। ওই সংখ্যায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ৮ লাখ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি আছে। দেশের প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৩ দশমিক ৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন।

দেখা যাচ্ছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি মানসম্পন্ন সেবার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা দেশের ৮ জেলার ১১টি সরকারি হাসপাতালে অভিযান চালিয়েছিলেন। ওই দিন হাসপাতালগুলোতে ২৩০ জনের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। বাস্তবে ছিলেন ১৩৮ জন। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ চিকিৎসক অনুপস্থিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপস্থিত স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসকের পক্ষে বিপুলসংখ্যক রোগীকে মানসম্পন্ন সেবা দেওয়া সম্ভব নয়।

প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুত থাকার বিষয়টিও সেবার মানের ওপর প্রভাব ফেলে। চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের প্রস্তুতির বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জরিপ প্রতিবেদনে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জরিপের খসড়া ফলাফলে বলা হয়েছে, পরিবার পরিকল্পনা সেবা, প্রসব–পূর্ব সেবা ও প্রসবসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি জেলা হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতির মান তিন বছরে কমেছে। ২০১৪ সাল থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবার মান নিম্ন অথবা অবনতি হয়েছে অথবা অপরিবর্তিত আছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি শূন্য।

সরকারের জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) ও আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এই জরিপ করেছিল। জরিপে দেশের ১ হাজার ৬০০ প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল ছয় ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠান—কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং জেলা হাসপাতাল। এ ছাড়া ২০ বা তার বেশি শয্যার বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক এবং এনজিও ক্লিনিকের ওপর জরিপ করা হয়। প্রশিক্ষিত ৪০টি দল ২০১৬ সালের ৩০ জুলাই থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ করে।

প্রথম আলো জরিপের যে মুখ্য ফলাফল পেয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি। এসব প্রতিরোধে হাসপাতালে অক্সিটসিন ও ম্যাগনেসিয়াম সালফেট রাখতে হয়। কিন্তু জরিপের সময় ৬৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে অক্সিটসিন ও ৮৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট পাননি জরিপকারীরা।

জরিপকারীরা ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে থার্মোমিটার পাননি। জেলা ও উপজেলা হাসপাতালের ২২ শতাংশে এক্স-রে যন্ত্র পাওয়া গিয়েছিল। ৪৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে শিশুযত্নে কোনো প্রশিক্ষিত জনবল পাওয়া যায়নি। গর্ভধারণ, প্রস্রাবে শর্করা, প্রস্রাবে প্রোটিন, রক্তে শর্করা ও হিমোগ্লোবিন—এসব পরিমাপের পাঁচটি যন্ত্র একসঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে।

দুর্নীতি কমছে না
ক্যাপসুলের মান ঠিক না থাকায় শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো কর্মসূচি শেষ মুহূর্তে স্থগিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ১৯ জানুয়ারি ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী ২ কোটি ২০ লাখ শিশুকে ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কথা ছিল। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান বলেছেন, ভারতীয় একটি কোম্পানির কাছ থেকে ভিটামিন ক্যাপসুল কিনতে সরকার বাধ্য হয়েছিল। অনেকেই মনে করেন, ঘটনার পেছনে দুর্নীতি আছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।

সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতির নজির পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন উপপরিচালক এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির ব্যাপ্তি দেখে বিস্মিত হচ্ছি।’ দুদক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা শাখার একজন কর্মচারীর দেশে ও বিদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদের হদিস পেয়েছে।

দুর্নীতির ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে। সরবরাহের সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু মানুষ দুর্নীতি করে। অন্য খাতের তুলনায় স্বাস্থ্যে দুর্নীতি কম। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুর্নীতি কমাতে ই–টেন্ডার পদ্ধতি চালু করছে। ভালো মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

দুর্নীতি করার কারণে কারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির দেখা যাচ্ছে না। প্রথম আলোর প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালককে ২০১৪ সালে ওএসডি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিছুদিন পর তাঁকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। গত বছরের মাঝামাঝি তাঁকে বদলি করে রাজধানীর একটি হাসপাতালের পরিচালকের পদে বসানো হয়। নতুন প্রতিষ্ঠানে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত করছে মন্ত্রণালয়।

২০১৩ সালে ২০ কোটি টাকার বেশি দাম দিয়ে লিনিয়ার এক্সিলারেটর নামের আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসা যন্ত্র কিনে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ওই যন্ত্রের জন্য কোনো চাহিদাপত্র দেয়নি খুলনা মেডিকেল। ওই যন্ত্র রাখার মতো কক্ষও নেই সেখানে। চালানোর মতো উপযুক্ত লোকও নেই। যন্ত্রটি খোলা আকাশের নিচে ছয় বছর ধরে পড়ে আছে। অভিযোগ আছে, এখনো এভাবে যন্ত্র কেনার ধারা অব্যাহত আছে। এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পারেনি মন্ত্রণালয়।

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি হয় ক্রয়ে (ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি), নির্মাণকাজে, নিয়োগ–পদোন্নতি ও বদলিতে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও শিক্ষার্থীর আসন বৃদ্ধিতে, এমবিবিএস ভর্তিতে। মাঠকর্মী থেকে মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এসব দুর্নীতিতে জড়িত। গত এক দশকের বেশি সময় এসব দুর্নীতি নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে বহু প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। পরিস্থিতি বদলায়নি।

নজরদারি বাড়াতে হবে
স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন আছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছরের বেশি। দেশের ৮৫ শতাংশের বেশি শিশু ভিটামিন এ পায়। মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৩ এবং জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতি ব্যবহারের হার ৬২ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, সেবার মূল্য কমানো ও মান বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতির রাশ টেনে ধরা সম্ভব হলে স্বাস্থ্য খাত আরও অনেক এগিয়ে যেত।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, নজরদারির ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে নজরদারি বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ও অধিদপ্তরগুলোতে বিশেষ সেল খোলার কাজ শুরু হয়েছে। এ রকম নজরদারি সেল প্রতিটি বিভাগেও খোলা হবে। এসব সেল পূর্ণমাত্রায় কাজ শুরু করলে সেবার মান বাড়বে, দুর্নীতিও কমবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সমস্যাগুলো পুরোনো ও বহুল আলোচিত। শুধু মুখের কথায় এসব সমস্যা দূর হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে নজরদারি বাড়াতে হবে। এ কাজে আধুনিক প্রযুক্তিরও সহায়তা নিতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে দিশারি প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে এবং সফল উদ্যোগের ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। এসব কাজে প্রয়োজনে আইনের সংস্কার করতে হবে।