সবাই মানসম্মত সেবা পায় না

>

• দেশে চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত বেশি
• বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানে মানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে
• খরচ বেশি বলে সবার পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়

দেশে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীরা মানসম্মত চিকিৎসা পাচ্ছে না। মানসম্মত সেবা দেওয়ার জন্য কমপক্ষে ১৭০টি সমন্বিত চিকিৎসাকেন্দ্র থাকা দরকার। আছে মাত্র ২৬টি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে অত্যধিক রোগীর চাপ। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খরচ বেশি বলে সবার পক্ষে চিকিৎসা করানো সম্ভব নয়।

দেশে ক্যানসারের প্রকোপ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের সর্বশেষ (২০১৮) পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিবছর দেড় লাখের বেশি মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালে বলেছিল, দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ২১ হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়।

ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের সংগঠন মেডিকেল অনকোলোজি সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি পারভীন শাহিদা আখতার বলেন, ক্যানসারের জন্য দরকার সমন্বিত চিকিৎসা। অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন থেরাপির, দক্ষ জনবল, যন্ত্রপাতি ও পরীক্ষাগার দরকার। তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো ও জনবল-স্বল্পতার কারণে মানুষ মানসম্মত সেবা পাচ্ছে না। 

বাংলাদেশ পরিস্থিতি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ১০ লাখ মানুষের জন্য একটি চিকিৎসাকেন্দ্র দরকার। আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ এই কেন্দ্রে থাকবে দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানদের একটি দল। ১৭ কোটি মানুষের দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী ১৭০টি কেন্দ্র দরকার।

গত বছরের নভেম্বর মাসে চূড়ান্ত করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিকসের ক্যানসার ও কিডনি রোগের চিকিৎসায় বিমাবিষয়ক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র আছে ২৬টি। এর মধ্যে সরকারি ১৬টি। ব্যক্তিমালিকানাধীন ও এনজিও পরিচালিত ১০টি।

দেশের ক্যানসার চিকিৎসার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ৩০০ শয্যার এই হাসপাতালে গতকাল রোববার সকাল ১০টায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি তলায় ব্যাপক ভিড়। মেঝেতে, বারান্দায় ব্যাগ-লেপ-তোশক নিয়ে ছোট ছোট পরিবারে সদস্যরা শুয়ে বা বসে আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার টাকা জমা দেওয়ার কাউন্টারের সামনে লম্বা সারি।

প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মো. মোয়াররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতের একটি বড় প্রতিষ্ঠানে ২১টি যন্ত্রে প্রতিদিন ৫০০ রোগীকে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়। আর আমরা ৬টি যন্ত্রে প্রতিদিন ৫৫০ রোগীকে থেরাপি দিই।’ এ ছাড়া প্রতিদিন বহির্বিভাগে ১ হাজার ২০০ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয় বলে তিনি জানান।

প্রতিষ্ঠানের রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, প্রতিষ্ঠানে আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। জনবলেরও কমতি নেই। কিন্তু বছরজুড়ে রোগীর চাপ বেশি থাকায় মানসম্মত সেবা দেওয়া যায় না। 

অর্থ বড় বাধা

জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানই দেশের দরিদ্র রোগীদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। গতকাল হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার খোলা জায়গায় মেয়েকে নিয়ে বসে ছিলেন শেরপুর থেকে আসা সানোয়ারা বেগম। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেয়ে শর্মিলা খাতুনের ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে আট আস আগে। ১৪ জানুয়ারি কেমোথেরাপি দেওয়ার কথা ছিল। অর্থের জোগাড় হয়নি বলে আসতে পারেননি।

শর্মিলার বাবা তজিমল হক দিনমজুর। তজিমল জানান, মেয়ের চিকিৎসার খরচ মেটাতে দুটি গরু বিক্রি করেছেন ৮০ হাজার টাকায়। আরও ১ লাখ ২০ হাজার টাকা সুদে ধার নিয়েছেন। চিকিৎসা কত দিন চলবে জানেন না, বাকি অর্থের জোগাড় কীভাবে হবে, তা-ও জানেন না। অধ্যাপক পারভীন শাহিদা আখতার ও হাবিবুল্লাহ তালুকদার দুজনই বলেছেন, অর্থের অভাবে মানুষ চিকিৎসা নেয় না বা মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ইকোনমিকসের ক্যানসার ও কিডনি রোগ চিকিৎসায় বিমাবিষয়ক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে একজন ক্যানসার রোগীর খরচ হয় ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৪৫ টাকা। যদি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা সরকারি হাসপাতালে হয়, তাহলে দুই লাখ টাকায় চিকিৎসা সম্ভব। সরকারি হাসপাতালে একজন রোগী ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার ওষুধ বিনা মূল্যে পায়।

নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ প্রতিটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যানসার ইউনিট খোলার এবং প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ক্যানসার গবেষণা ইউস্টিটিউটের পরিচালক মো. মোয়াররফ হোসেন বলেন, সব ধরনের সেবা শুধু এই হাসপাতালেই পাওয়া যায়। তাই সারা দেশের রোগী এখানে আসে। রোগীর চাপ বেশি, শয্যা কম। ঢাকায় থাকার জন্য অনেককে বাড়তি খরচ করতে হয়। সবাই তা পারে না। তিনি বলেন, সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলে পরিস্থিতি অনেক পাল্টে যাবে। 

আজ বিশ্ব ক্যানসার দিবস

আজ সোমবার বিশ্ব ক্যানসার দিবস। দিবসটি পালন উপলক্ষে সরকার নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে সকালে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ক্যানসার নিয়ে আলোচনা হবে। এ বছরের প্রতিপাদ্য, ‘আমি আছি, আমি থাকব—ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।’

দিবসটি পালন উপলক্ষে বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতাল গতকাল ক্যানসার যোদ্ধাদের নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করে। অন্যদিকে বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে দেশের ক্যানসার পরিস্থিতি ও করণীয় সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলন করে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।