মা-বাবার নামে বিনা মূল্যে চিকিৎসা, অনাথালয়

ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আলীর গড়ে তোলা বিনা মূল্যের চিকিৎসাকেন্দ্র। ছবি: প্রথম আলো
ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আলীর গড়ে তোলা বিনা মূল্যের চিকিৎসাকেন্দ্র। ছবি: প্রথম আলো

আধুনিক একটি চারতলা ভবন। ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। গ্রামে এমন ভবন যে–কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। যে উদ্দেশ্যে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে, তা শুনলেও মন ভালো হয়ে যাবে। একজন ব্যবসায়ী তাঁর মা-বাবার স্মরণে সেই ভবনে গড়ে তুলেছেন বিনা মূল্যের চিকিৎসাকেন্দ্র ও অনাথালয়। চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সামমাহালদারপাড়া গ্রামে এটির অবস্থান।

চট্টগ্রামে কাপ্তাই সড়কপথে মদুনাঘাট পার হয়ে কমলার দিঘি নেমে হজরত মোহাম্মদ শাহ সড়ক হয়ে সামান্য ভেতরে ঢুকলেই সামমাহালদারপাড়া গ্রাম। চট্টগ্রাম নগরীর তরুণ ব্যবসায়ী মুহাম্মদ আলী স্বেচ্ছাসেবামূলক এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। চট্টগ্রাম শহরে তাঁর গাড়ির শোরুম, পোশাক বিক্রির একাধিক প্রতিষ্ঠানসহ নানা ব্যবসা রয়েছে।

মুহাম্মদ আলী বলেন, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবায় বাবা হাজী জালাল খায়ের ও মা আয়েশার নামে তিনি এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিবছর এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে চট্টগ্রাম নগর থেকে ৩০–৩৫ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে বিনা মূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৬ সালের ৩১ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে। এরপর থেকে নিয়মিত স্বেচ্ছাসেবামূলক কর্মসূচি চলে আসছে।

বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সেখানে গত ১ ফেব্রুয়ারি দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় বিনা মূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্প। এদিন মোট ২ হাজার ৮০০ রোগী এখান থেকে বিনা মূল্যে ওষুধ, সেবা ও দুপুরের খাবার পান। এই ক্যাম্পের উদ্বোধন করেন চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) কেন্দ্রীয় পরিষদের সহসভাপতি ডা. শেখ শফিউল আজম।

শেখ শফিউল আজম বলেন, প্রতিষ্ঠানটি দেশের জন্য একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।

সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটির নিচতলায় বড় পরিসরে খোলা হয়েছে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবার জন্য মেডিকেল সেন্টার। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে পবিত্র কোরআন শরিফ মুখস্থ করার জন্য হিফজুল কোরআন বিভাগ। তৃতীয় তলার পুরো ফ্লোর অনাথ শিশুদের আবাসিক হোস্টেল। সেখানে মা-বাবাহারা ৩০টি ছেলেশিশু বিনা খরচে থাকা, খাওয়া ও লেখাপড়া করছে। চতুর্থ তলায় আছে কারিগরি, কম্পিউটার ও নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্র।

বিনা মূল্যের চিকিৎসা নিতে ভিড় করেছেন গ্রামবাসী। ছবি: প্রথম আলো
বিনা মূল্যের চিকিৎসা নিতে ভিড় করেছেন গ্রামবাসী। ছবি: প্রথম আলো

নিচতলায় একজন চিকিৎসকের কাছে সেবা নিচ্ছিলেন রোগীরা। মরিয়ম বেগম নামের এক রোগী প্রথম আলোকে বলেন, অসুখ হলে সব সময় তিনি এখানে ছুটে আসেন। বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা পান।

চিকিৎসক রবিউল মুস্তফা বলেন, প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ জন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত রোগীদের বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া হয়।

প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরুর দিন থেকে অনাথালয়ে থাকা শিশু ওমর ফারুক জানায়, তিন বছর ধরে সে এখানে বসবাস করছে। পড়ালেখাও করছে। অসুস্থ হলেও এখানেই চিকিৎসাসেবা পায়।

হাসপাতালটির পাশেই প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলীর পৈতৃক বাসভবন। সেখানে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবা ও মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এটি গড়ে তুলেছি। এলাকার দরিদ্র ও মা-বাবাহারা ছাত্ররা এখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভর্তির সুযোগ পায়। লেখাপড়া, থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসাসেবাসহ তাদের সব খরচ আমরা বহন করি। পাশাপাশি কারিগরি ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে।’

প্রতিষ্ঠানের তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলীর ছোট ভাই লিয়াকত আলী, শওকত আলী ও লোকমান আলী।

এ প্রসঙ্গে রাউজান উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মুনির হোসেন বলেন, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবার জন্য বেসরকারিভাবে এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মহৎ কাজ। সরকারের পাশাপাশি দেশের বিত্তবানদের জন্য এ প্রতিষ্ঠান অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে।