অস্ত্র হাতে ঢুকে তিন-চারজন যুবক জিজ্ঞাসা করেন, 'আমরা মুসলমান কি না'

হোলি আর্টিজান
হোলি আর্টিজান

কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অস্ত্র হাতে তিন-চারজন যুবক গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে শারমিনা পারভিনদের কাছে জানতে চান, তাঁরা মুসলমান কি না। হ্যাঁ-সূচক জবাব দেওয়ার পর ওই যুবকেরা তাঁদের বলেছিলেন, ‘মুসলমান হলে কোনো সমস্যা হবে না।’ এরপর তাঁদের পেছনে থাকা ৮ থেকে ১০ জন বিদেশিকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন ওই যুবকেরা।

হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী শারমিনা পারভিন সাক্ষী হিসেবে আজ বুধবার ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এই জবানবন্দি দেন। শারমিনা পারভিন হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক হাসনাত করিমের স্ত্রী। শারমিনা ছাড়া আরও দুজন সাক্ষী আদালতে জবানবন্দি দেন। তাঁরা হলেন ওই হামলায় নিহত সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল করিমের সহোদর শামসুজ্জামান ও তাঁর খালাতো ভাই মোল্লা আনোয়ারুল আমিন।

১২ ফেব্রুয়ারি এ মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেছেন সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো.মজিবুর রহমান।

আশপাশে ছিল মৃতদেহ
শারমিনা পারভিন তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে ও স্বামী হাসনাত করিমকে নিয়ে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজানে রাতের খাবার খেতে যান। ওই দিন তাঁর মেয়ের জন্মদিন ছিল।

শারমিনা পারভিন আদালতকে বলেন, সেদিন হোলি আর্টিজান বেকারির হলরুমে বসে ছিলেন। খাবারের মেনু দেখে অর্ডার দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ করেই তিন-চারজন যুবক কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে হোলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে পড়েন।

শারমিনা বলেন, ‘ওই যুবকেরা আমাদের টেবিলের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন, আমরা মুসলমান কি না। আমরা মুসলমান জানালে তাঁরা বলেন, “আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না।” তাঁরা টেবিলে মাথা নিচু করে থাকার পরামর্শ দেন। যুবকেরা বলেন, ‘আমরা মুসলমানদের কোনো ক্ষতি করব না।”’

শারমিনা পারভিন আদালতকে জানান, হোলি আর্টিজান বেকারির যে টেবিলে তাঁরা বসেছিলেন, এর পেছনে ৮ থেকে ১০ জন বিদেশি বসা ছিলেন। তাঁরা সেখানে গুলি শুরু করেন। তখন তাঁদের ছেলেমেয়ের চোখ ঢেকে রাখেন। কিছুক্ষণ পর দুই মেয়ে, এক ছেলে এবং অপর একজন লোককে ওই যুবকেরা তাঁদের টেবিলের কাছে এনে বসান। এভাবেই তাঁদের সারা রাত সেখানে বসিয়ে রাখা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় হলরুমের সব লাইট। কেবল বারান্দার একটা লাইট জ্বালানো ছিল।

শারমিনা পারভিন আদালতকে আরও বলেন, রাত দেড়টার দিকে একজন কর্মী (ওয়েটার) এবং একজন বিদেশিকে তাঁদের টেবিলের কাছে নিয়ে আসেন ওই যুবকেরা। বাঙালি ওয়েটারকে এক পাশে সরিয়ে রাখা হয়। এরপর তাঁদের সামনে বিদেশি নাগরিককে গুলি করা হয়।

হোলি আর্টিজানের সেদিনকার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শারমিনা পারভিন বলেন, ‘আমাদের চারপাশে ডেডবডি (মরদেহ) ছড়ানো ছিল। সেগুলো ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর শব্দ শুনতে পাই।’

হাসনাত করিম ও তাহমিদ প্রসঙ্গে শারমিনা বলেন, ‘ভোর আনুমানিক ছয়টার সময় আমার স্বামী এবং তাহমিদকে অস্ত্রের মুখে তারা ছাদে নিয়ে যান। এর ৫ থেকে ১০ মিনিট পর আবার তাঁদের আমাদের টেবিলের কাছে নিয়ে আসে। আমার স্বামীকে চাবি দিয়ে গেটের তালা খুলে দেয়। তারা বলে, আপনারা এক-এক করে বের হয়ে যান। ফেরত আসার সময় আমাদের মোবাইলসহ যা যা নেওয়া হয়েছিল, তাও ফেরত দেওয়া হয়। এরপর আমরা বের হয়ে আসি। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের হেফাজতে নিয়ে নেয়। এরপর আমাদের ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।’

হাসনাত করিমের স্ত্রী শারমিনার জবানবন্দি শেষ হলে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ তাঁকে জেরা করেন। উল্লেখ্য, এ মামলায় হাসনাত করিমকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

আসামি রাশেদ ওরফে র‍্যাশ, রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর ও আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। অপর দুই আসামি শহীদুল ইসলাম খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হলেও তাঁদের এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় ২ পুলিশসহ ২২ জন নিহত হন।