প্রেমের সন্দেহ, অন্ধকার ঘরে ২ বছর মেয়েটি

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মেয়েটিকে। নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ৬ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এ এস এম আলমগীর
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মেয়েটিকে। নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ৬ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এ এস এম আলমগীর
>

• মেয়েটিকে ছয় মাস ধরে গোসল করতে দেওয়া হয়নি
• অন্ধকার ঘরে বন্দী থাকায় তাঁর হাত-পায়ের আঙুলগুলো গেছে কুঁকড়ে। জীর্ণ-শীর্ণ শরীর, রক্তশূন্যতা, চর্মরোগসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত মেয়েটি
• প্রেমের সম্পর্কের সন্দেহে শাস্তি হিসেবে তাঁকে অন্ধকার ঘরে বন্দী রাখা হয়

দুই বছরের বেশি সময় স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরে স্নাতকপড়ুয়া ছাত্রীকে (২২) আটকে রেখেছিল তাঁর পরিবার। বন্দিদশায় তাঁর হাত-পায়ের আঙুলগুলো গেছে কুঁকড়ে। জীর্ণ-শীর্ণ শরীর, রক্তশূন্যতা, চর্মরোগসহ নানা সমস্যায় আক্রান্ত মেয়েটি মরতে বসেছিলেন। এমন খবর পেয়ে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) হস্তক্ষেপে মেয়েটিকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বলছেন, যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারত মেয়েটির। ছাত্রীটির মা বলছেন, কবিরাজ ও স্বপ্নে দেখা এক ব্যক্তির পরামর্শে মেয়েকে ওইভাবে ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন।

প্রতিবেশী ও স্থানীয় বাসিন্দা জানান, ওই পরিবারের সঙ্গে বিরোধ আছে—এমন এক পরিবারের ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের সন্দেহে প্রায় আড়াই বছর ধরে ওই ছাত্রীকে তাঁর পরিবার আটকে রেখেছিল। বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকলেও যে ঘরে মেয়েটিকে আটকে রাখা হয়, সেই ঘরে কোনো বিদ্যুৎ–সংযোগ ছিল না। এমনকি ঘরের দরজা-জানালা সব সময় তালা মেরে রাখা হতো।

গতকাল ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, ছাত্রীটির মুখ ও পা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। হাতের আঙুলগুলো কুঁকড়ে গেছে। কিছুতেই বসে থাকতে বা দাঁড়াতে পারছেন না। কথা বলতে গেলে শরীর কাঁপুনি দিচ্ছে। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বের হচ্ছে তাঁর শরীর থেকে।

নবাবগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন অপচিকিৎসায় ও বদ্ধ ঘরে থাকায় ছাত্রীটির রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে। সূর্যের আলোয় না আসায় এবং হাঁটাচলা না করায় দেখা দিয়েছে হাড়ক্ষয় রোগ। পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে চর্মরোগ, আর মুখে ফাঙ্গাস। ছাত্রীটি শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এভাবে কিছুদিন থাকলে যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারত ছাত্রীটির। এখন তাঁকে সুস্থ করতে সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক নার্স প্রথম আলোকে বলেন, ওই তরুণী তাঁকে জানিয়েছেন, ছয় মাস ধরে তাঁকে গোসল করতে দেওয়া হয়নি।

নবাবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা ছাত্রীটির খালাতো বোন প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর ধরে চেষ্টা করেও তিনি তাঁর খালাতো বোনের (ছাত্রীটির) সঙ্গে দেখা করতে পারেননি।

সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আশরাফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওই ছাত্রীর চাচা দুই বছর আগে ছাত্রীকে আটক রাখার বিষয়টি জানান। তখন তিনি ওই ছাত্রীর বাড়িতে গেলে তাঁর সঙ্গে কেউ কথা বলেননি। পারিবারিক ইস্যু দেখালে তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন।

স্নাতকপড়ুয়া ছাত্রীকে দুই বছর পর অন্ধকার ঘর থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ৬ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এ এস এম আলমগীর
স্নাতকপড়ুয়া ছাত্রীকে দুই বছর পর অন্ধকার ঘর থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ৬ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এ এস এম আলমগীর

বন্দিদশা থেকে উদ্ধার হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই তরুণী প্রথম আলোকে বলেন, রংপুরের একটি স্কুলে মানবিক বিভাগ থেকে তিনি ২০১১ সালে এসএসসি ও নবাবগঞ্জের একটি কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে তাঁর।

ইউএনও মো. মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দুই বছরের বেশি সময় আটকে রাখার খবর পেয়ে ওই ছাত্রীর মাদ্রাসাশিক্ষক বাবাকে ডেকে পাঠান। ছাত্রীর বাবা ইউএনওকে জানান, ছাত্রীর মা একক কর্তৃত্বে ছাত্রীটিকে আটক রেখেছেন। এরপর ইউএনও পুলিশ পাঠিয়ে ছাত্রীটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।

মশিউর রহমান বলেন, এই সভ্য সমাজে কোনো পরিবার তার সুস্থ–স্বাভাবিক সন্তানকে এভাবে বন্দী করে রেখে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে নিয়ে যেতে পারে, তা ভেবে অবাকই হচ্ছেন। ছাত্রীটির যাবতীয় চিকিৎসার ব্যয় তিনি বহন করবেন। ছাত্রীটিকে সুস্থ করে আবারও লেখাপড়া শুরু করাবেন।

মেয়েটিকে উদ্ধারে যাওয়া নবাবগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উদ্ধারে গেলে প্রতিবেশীরা জানান, দুই বছরের বেশি সময় ধরে ওই ছাত্রীকে আটকে রাখা হয়েছিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রতিবেশী প্রথম আলোকে জানান, ওই পরিবারের সঙ্গে বিরোধ আছে —এমন পরিবারের এক ছেলের সঙ্গে ওই মেয়ের প্রেমের সম্পর্কের সন্দেহে তাঁকে শাস্তি দিতে ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল।