বাড়িতে বাবার লাশ, ছেলে পরীক্ষাকেন্দ্রে

বাবার লাশ বাড়িতে রেখে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে ইফতি আকবর তাওসিফ। পেকুয়া, কক্সবাজার, ৭ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এস এম হানিফ
বাবার লাশ বাড়িতে রেখে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে ইফতি আকবর তাওসিফ। পেকুয়া, কক্সবাজার, ৭ ফেব্রুয়ারি। ছবি: এস এম হানিফ

‘যখন প্রাইমারিতে পড়ি বাবা ক্লাসে বলতেন, বাড়িতে কেউ মারা গেলেও তার লাশ এক পাশে রেখে ক্লাসে যেতে হবে, পরীক্ষা দিতে হবে। আল্লাহ বাবার সেই কথাটি আমার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করেছেন।’ কথাগুলো একজন এসএসসি পরীক্ষার্থীর—যার বাবা আজ বৃহস্পতিবার পরীক্ষার পূর্বমুহূর্তে মারা গিয়েছেন।

ঘটনাটি ঘটে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায়। শোকাহত ওই শিক্ষার্থী তার বাবার লাশ রেখেই পরীক্ষার হলে যায়। কর্তব্যরত শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, সে মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছে। আজ ছিল তাদের ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা।

এই শিক্ষার্থীর নাম ইফতি আকবর তাওসিফ। তার বাবা নাজিম উদ্দিন (৪৫) ছিলেন পেকুয়া সদর ইউনিয়নের পূর্ব গোঁয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হলে গত সোমবার তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ সকাল ছয়টায় সেখানেই তিনি মারা যান।

পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, নাজিম উদ্দিনের মরদেহ হাসপাতাল থেকে সকাল সাড়ে নয়টায় বাসায় পৌঁছায়। তাওসিফ তার বাবার মরদেহ একনজর দেখেই কাঁদতে কাঁদতে পরীক্ষার কেন্দ্রে ছোটে। তাওসিফ উপজেলার শীলখালী উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। সে অষ্টম শ্রেণিতে জিপিএ ৫ ও বৃত্তি পায়। পরিবারের দ্বিতীয় ছেলে তাওসিফের আরও তিন ভাই আছে। বড় ভাই চট্টগ্রাম বিএফ শাহিন কলেজে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে, তৃতীয় ভাই চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে। সবার ছোট ভাই ইসরাক বিল্লাহর বয়স মাত্র চার বছর। 

নাজিম উদ্দিন
নাজিম উদ্দিন

পরীক্ষা শেষে কথা হয় তাওসিফের সঙ্গে। সে বলে, ‘যখন প্রাইমারিতে পড়ি বাবা ক্লাসে সব সময় বলতেন বাড়িতে কেউ মারা গেলেও তার লাশ এক পাশে রেখে ক্লাসে যেতে হবে, পরীক্ষা দিতে হবে। আল্লাহ বাবার সেই কথাটি আমার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করেছেন। জীবিত বাবার চেয়ে মৃত বাবা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন বেশি।’

পেকুয়া বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের কেন্দ্রসচিব আবদুল কাদের বলেন, ‘বাড়িতে বাবার লাশ রেখে পরীক্ষাকেন্দ্রে আসায় ওই পরীক্ষার্থীকে দেখতে যাই। চেহারায় কষ্টের ভাব দেখা গেলেও মানসিকভাবে তাকে অনেক শক্ত মনে হয়েছে। লেখাতে যথেষ্ট মনোযোগ ছিল।’

পূর্ব গোঁয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (নাজিম উদ্দিনের ছাত্র) গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘গোঁয়াখালী এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে স্যারের অবদান ছিল খুব বেশি। বিদ্যালয়টি বেসরকারি থাকা অবস্থায় আর্থিক অনটনের মধ্যেও স্যার নিয়মিত ক্লাস চালিয়ে নিতেন। এখন আমরা একজন অভিভাবককে হারিয়েছি।’

পেকুয়া সদর ইউপির নারী সদস্য (গোঁয়াখালী এলাকা) বুলবুল জান্নাত বলেন, ‘তাওসিফ জেএসসিতে জিপিএ-৫ ও বৃত্তি পেয়েছিল। আজকে বাবার লাশ রেখে সে পরীক্ষার কেন্দ্রে গেছে, তাও এলাকায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। নাজিম উদ্দিনের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।’

তাওসিফের সহপাঠী হিরু আলম বলে, ‘তাওসিফ বেশ মেধাবী। পড়ালেখার প্রতি তার খুব টান। বাবার লাশ ঘরে রেখেই সে আমাদের সঙ্গে কেন্দ্রে বসে পরীক্ষা দিয়েছে।’