ছোট্ট শরীরে এমন যন্ত্রণা!

>
  • ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা গেছেন মা
  • পা হারিয়ে দুই মাস বয়সী শিশুটি ভর্তি হাসপাতালে
  • সৎমা দেখাশোনা করছে শিশুটির
  • বাবা আসেননি
ডান পা হারিয়ে দুই মাস বয়সী শিশুটি  এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ  হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।  প্রথম আলো
ডান পা হারিয়ে দুই মাস বয়সী শিশুটি এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। প্রথম আলো

দুই মাস বয়সী শিশুটির ডান পায়ের হাঁটু থেকে নিচ পর্যন্ত কাটা পড়েছে। সেই পায়ের পুরোটা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। বাঁ পায়ের পাতায় বিদ্ধ স্যালাইনের সুচ। হাতেও লেগেছে ইনজেকশনের দাগ। একরত্তি শরীরটা এত এত যন্ত্রণা সইতে না পেরে কেঁদে যাচ্ছিল সমানে।

গতকাল শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে (অর্থোপেডিকস বিভাগ) এভাবেই পাওয়া গেল ট্রেনে কাটা পড়ে পা হারানো শিশুটিকে। যে দুর্ঘটনায় তার মা রোকসানা বেগমের দেহ হয়েছে দ্বিখণ্ডিত।

হাসপাতালে বাচ্চাটিকে দেখভাল করছিল সৎমা নাজমা আক্তার। নাজমার ঘরে চার সন্তান রেখে রোকসানাকে বিয়ে করেন মোহাম্মদ রাসেল। শিশুটির এই দুর্দিনে বাবা রাসেল না থাকলেও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ভুলে ছুটে এসেছেন নাজমা। সঙ্গে আছে তাঁর দেড় বছরের কন্যা শিশু। সেই শিশুটি তার আহত সৎবোনকে চুমু দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

নাজমা বলেন, ‘একজন হিজড়া ও মহিলা বাচ্চাটিকে উদ্ধার করে আমাদের খবর দেয়। এরপর পুলিশের সঙ্গে আমিও হাসপাতালে ছুটে এসেছি। একবার নিজের বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করাচ্ছি, আরেকবার তাকে (আহত শিশু) দুধ পান করাচ্ছি।’

আপনার স্বামী রাসেল আসেনি-এমন প্রশ্নে নাজমা বলেন, ‘না আসেনি, খোঁজও নেয়নি।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিত্যদিনের মতো গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় ঢাকাগামী তূর্ণা-নিশীথা ট্রেনে ভিক্ষা করছিলেন রোকসানা। কোলে ছিল বাচ্চাটি। কদমতলী রেলক্রসিং এলাকায় একটু গতি কমলে তিনি ট্রেন থেকে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভারসাম্য রাখতে না পেরে ছিটকে পড়েন ট্রেনের চাকার নিচে। সেখানেই তিনি দ্বিখণ্ডিত হয়ে মারা যান। তবে বিপদ বুঝে রোকসানা বাচ্চাটিকে ছুড়ে মেরেছিলেন অদূরে। তাই ডান পা কাটা পড়লেও বেঁচে যায় শিশুটি। পরে বাচ্চাটিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন রেলওয়ে থানার (জিআরপি) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজ ভূঁইয়া।

রোকসানা তার বাচ্চাটির নাম দিয়েছিলেন সাথি। শখ করে মেয়ের ডান হাতে লাগিয়েছিলেন রেশমের ফিতা। গলায় ঝুলিয়েছেন একগুচ্ছ তাবিজ আর মালা। জন্মের দুই মাসেই যন্ত্রণার সবকিছু অনুভব করে ফেলা ফুটফুটে সাথিকে দেখে হাসপাতালের রোগী ও তাদের স্বজনেরা বলেছিলেন, মা না থাকলেও সৎমা বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধে নেমেছেন। কিন্তু হাসপাতালের চিকিৎসক কিংবা নার্সদের যেন কোনো দায়িত্ব নেই।

চিকিৎসকদের কক্ষে গিয়ে পাওয়া যায়নি কাউকে। নার্সদের সঙ্গে কথা বলেও মেলেনি কোনো সাড়া। হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক শীলব্রত বড়ুয়া বলেন, বাচ্চাটি শঙ্কামুক্ত নয়।

বাচ্চাটির পাশে দাঁড়াতে ছুটে আসছেন কেউ কেউ। তাঁদের একজন চা-পাতা ব্যবসায়ী মো. নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘দুপুরে দোকানে বসে পত্রিকা পড়ছিলাম। হঠাৎ বাচ্চাটির খবরটি চোখে পড়ে। বাচ্চাটির কষ্টের কথা জেনে নিজের দুটো বাচ্চার মুখ চোখে ভাসছিল। তাই সহযোগিতা করতে ছুটে এলাম হাসপাতালে।’ নাসির যখন কথা বলছিলেন তখনো কাঁদছিল শিশুটি। শিশুটির সেই কান্না সংক্রমিত হলো নাসিরের চোখেও।