সাগর-রুনি খুনের রহস্য বের হবে না?

সাগর-রুনি
সাগর-রুনি

তদন্তের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চরম ব্যর্থতার উদাহরণ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলা। সাত বছরে ৬৩ বার সময় নিয়েও আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি র‍্যাব। তদন্তের এই ব্যর্থতা নিয়ে নিহত সাগর-রুনির পরিবার ও স্বজনেরা ক্ষুব্ধ, ব্যথিত। 

আদালত সূত্র বলছে, আলোচিত এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ১৭ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) এএসপি সহিদার রহমান আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি গত বছরের ১১ নভেম্বর মামলার তদন্তভার পেয়েছি। এ মামলা যাঁরা আগে তদন্ত করেছেন তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। মামলার বাদীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, সাগরের মাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তা তদন্তের স্বার্থে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমাদের কাজ এগোচ্ছে।’

সহিদার রহমান আরও বলেন, ‘আমরা তথ্যের ভিত্তিতে এগোচ্ছি। চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছি না। চেষ্টা করলে সবকিছু সম্ভব। হত্যার মোটিভের ব্যাপারে এই মুহূর্তে কিছু বলা সম্ভব নয়।’

এই খুনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আলামত পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলে মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে বলে এর আগে র‍্যাবের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন। এখন সেসব প্রতিবেদন র‍্যাবের হাতে। কিন্তু সেখান থেকে পাওয়া দুজন অজ্ঞাত পুরুষের ডিএনএ বহনকারী ব্যক্তি এখনো শনাক্ত হয়নি।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নিহত সাংবাদিক দম্পতির চুরি যাওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার মোট আটজনের মধ্যে ছয়জন এখনো কারাগারে। অন্য দুজন জামিনে আছেন।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাড়িতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। সাগর তখন মাছরাঙা টিভিতে আর রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল তাঁদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ। হত্যাকাণ্ডে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঘটনাস্থলে এসে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটন করা হবে। সেই ৪৮ ঘণ্টা এখন সাত বছরে গিয়ে ঠেকেছে।

২০১২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১০ অক্টোবরের মধ্যে সাগর-রুনির হত্যারহস্য উদ্‌ঘাটিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর ৯ অক্টোবর ‘চমক দেওয়া’ সংবাদ সম্মেলনে একজনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। পরে সেই ব্যক্তিকে ধরেও মামলার কোনো সুরাহা হয়নি।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পরে প্রথমে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ ও পরে ডিবি এই মামলার তদন্তভার পায়।

তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় (২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল) হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র‍্যাবকে মামলার তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই থেকে র‍্যাব মামলাটি তদন্ত করছে। তদন্তভার পেয়েই ভিসেরা পরীক্ষার জন্য কবর থেকে সাগর-রুনির লাশ উত্তোলন করে র‍্যাব। র‍্যাবের কর্মকর্তারা জানান, ভিসেরা পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাঁদের মৃত্যুর আগে কোনো প্রকার বিষাক্ত বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করানো হয়নি। আর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছুরিকাঘাতে রক্তক্ষরণ ও আঘাতের কারণে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

২০১৫ সালের ৭ জুন আদালতে দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে র‍্যাব জানায়, ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা আলামত যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে ফরেনসিক ও রাসায়নিক পরীক্ষার পর সেখান থেকে দুজন অজ্ঞাত পুরুষের পূর্ণাঙ্গ ডিএনএ বৃত্তান্ত পাওয়া গেছে।

সব মিলিয়ে এই মামলায় এখন পর্যন্ত মোট আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল এবং নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। তাঁদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র‍্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হন। প্রথম পাঁচজন ও নিরাপত্তারক্ষী এনামুল এখনো এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবাস করছেন।

নিহত সাংবাদিক সাগরের মা সালেহা খানম ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্র যদি না চায় তাহলে তো কারও বের করার ক্ষমতা নেই। সরকারের যদি সদিচ্ছা না থাকে তাহলে আর কী। কত বড় বড় ঘটনা বের হয়ে গেল। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার আসামিদের ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আর সাগর-রুনির খুনের রহস্য বের হবে না?’